সোমবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

সিনেমা হল কেন দর্শকশূন্য

সিনেমা হল কেন দর্শকশূন্য

নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে সিনেমা হলে দর্শক খরা দেখা দেয়। মানুষ ঘরে বসে ভিনদেশি ছবি আর সিরিয়াল দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ছোট পর্দায় ছবি আর সিরিয়াল চললেও দর্শক কিন্তু সিনেমা দেখতে ঠিকই সিনেমা হলে যায়। এখানে কেন দর্শক সিনেমা হল বিমুখ? এ বিষয়ে কয়েকজন সিনেমা হল মালিকের বক্তব্য তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

কাজী ফিরোজ রশিদ [সাবেক সভাপতি, প্রদর্শক সমিতি]

মানসম্মত ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। পর্যাপ্ত ছবিও নেই। দর্শক যে ধরনের গল্প আর গানের ছবি চায়, যা দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে, পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে চায় তারও অভাব। এতে দর্শক দেশীয় ছবির প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে এবং সিনেমা হলগুলো দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সাউন্ড সিস্টেম ও প্রজেক্টর স্থাপন করা হয়েছে। তার পরেও মানসম্মত ছবি নেই বলে দর্শকের অভাবে সিনেমা হল ভেঙে তাতে মার্কেট তৈরিতে বাধ্য হচ্ছে মালিকরা। সরকারি অনুদানে যে ছবি নির্মাণ হয় তা টেলিফিল্মের মতোই। দর্শক সেগুলো দেখে না। দর্শক বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি দেখতে চায়। সিনেপ্লেক্স সাধারণ দর্শকের জন্য নয়। তাতে ইংরেজি ছবি বেশি প্রদর্শন হয় এবং টিকিটের মূল্যও বেশি। আমার নিজের ৮টি সিনেমা হলের মধ্যে ৫টিই লোকসানের কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।

 

সুদীপ্ত কুমার দাস [প্রধান উপদেষ্টা, প্রদর্শক সমিতি]

২০০২ সাল থেকে যখন সিনেমা হল বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে তখন থেকেই প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তারা চিৎকার করে আসছি। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম আর ভাঙে না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতিযেগিতাহীন বাজারে পণ্যের মান ভালো হয় না। প্রতি

যোগিতাবিহীন যেনতেন ছবি নির্মাণ করলেই দর্শক দেখবে এটি নির্মাতাদের ধারণা। এই ধারণায় নির্মিত কিছু ছবি দর্শক প্রথম দিকে দেখলেও পরে একঘেয়েমির কারণে তা বর্জন করেছে। নীতিমালা ছাড়াই ১৯৯৯ সাল থেকে স্যাটেলাইট চ্যানেলে সেন্সরবিহীন ভারতীয় ছবি প্রদর্শন চলছে। একই ছবি বৈধভাবে আমদানি করে সিনেমা হলে প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে স্যাটেলাইট চ্যানেলের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে সিনেমা হলকে। ফলে দর্শকের অভাবে লোকসান দিয়ে বন্ধ হচ্ছে সিনেমাহ ল। এর পরেও একশ্রেণির চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী ভারতীয় ছবি আমদানি করলে তাদের রুটি রুজি বন্ধ হয়ে যাবে অযৌক্তিক দাবি জানালেও নিজেরাও মানসম্মত ছবি নির্মাণ করতে পারছে না। তাদের অভিযোগের তীর শুধুই প্রদর্শক সমিতি আর সিনেমা হলের পরিবেশের দিকে। তর্কের খাতিরেই প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে সাম্প্রতিক সময়ের ব্যবসা সফল শিকারি, নবাব, আয়নাবাজি ছবিগুলো প্রদর্শনের সময় সিনেমা হলের পরিবেশ কি আপনাআপনি ঠিক হয়ে গেল? প্রদর্শকরা অনুভব করে কারিগরি উৎকর্ষতার এই যুগে আধুনিক প্রযুক্তি ও দর্শকের আরামের ব্যবস্থা করা ব্যবসায়িক স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু দেড় যুগ ধরে মানসম্মত ছবির অভাবে লোকসান গুনে সিনেমা হল সংস্কার কীভাবে সম্ভব? এ জন্য ছবি আমদানি এবং বিদেশি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে মানসম্মত ছবি নির্মাণ করলে হল মালিকরা দর্শক পেয়ে ঋণ করে হলেও সব সিনেমা হল আধুনিক করতে সাহস পাবে এবং সিনেমা হল বন্ধ রোধ ও নতুন সিনেমা হল নির্মাণ শুরু হবে।

 

ইফতেখার নওশাদ [সভাপতি, প্রদর্শক সমিতি]

মানসম্মত ছবি নেই। প্রযোজকরা লগ্নি করছে ঠিকই কিন্তু সেই ছবিতে ভালো গল্প, শিল্পী আর গানের অভাব। স্থানীয় নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীরা বিদেশি ছবির বিরোধিতা করলেও ভালো ছবি দিতে পারছে না। ভালো ছবি না পেলে দর্শক সিনেমা হলে আসবে কেন? বিদেশি ছবি আমদানি করলে প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভালো ছবি নির্মাণ সম্ভব হতো। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান। সেখানে এক সময় স্থানীয় ছবির বাজারে ধস নেমেছিল। তারা সিনেমা হল বাঁচাতে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন শুরু করে। এতে প্রতিযোগিতায় গিয়ে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত ছবি নির্মাণ শুরু এবং সেসব ছবি শুধু দেশে নয় বিদেশেও সফলতা লাভ করে। আমার প্রশ্ন আমাদের এখানে যারা ভারতীয় ছবির বিরোধিতা করছে তারা শুধু হিন্দি ছবির বিপক্ষে থাকলে চলত, কলকাতার বাংলা ছবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিল কেন? প্রধানমন্ত্রী যেখানে সিনেমা হলকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছেন সেখানে ছবি না থাকলে এই ডিজিটালকরণে অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।

 

আবদুল আজিজ [প্রদর্শক, চেয়ারম্যান, জাজ মাল্টিমিডিয়া]

দর্শক পছন্দের ছবি নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে নির্মাণ বন্ধ। দর্শক অত্যাধুনিক নির্মাণ, জীবনের গল্প, শ্রুতিমধুর গান শুনতে চায়। এ ধরনের ছবি বছরে কয়টি নির্মাণ হচ্ছে? দায়সারা গোছের নাটক মার্কা ছবি নির্মাণ করলে দর্শক তা দেখবে কেন? এখন প্রযুক্তি সবার হাতের নাগালে। চাইলেই বিশ্বের উন্নত যে কোনো ছবি, গান আর আগ্রহের সবই দেখা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে দর্শকদের যেনতেন নির্মাণ দিয়ে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা বোকার স্বর্গে বসবাসের সমতুল্য। অথচ বিগ বাজেট আর অ্যারেঞ্জমেন্টের ছবি হলে দর্শক যে সিনেমা হলে তা দেখতে যায় তার প্রমাণ জাজের শিকারি, নবাব, বাদশা, বস টু, অগ্নি, ভালোবাসার রঙ, রোমিও ভার্সেস জুলিয়েটসহ আরও অনেক ছবি। জাজ মাল্টিমিডিয়া চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে ২০১২ সাল থেকে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন মুখ, বিগ বাজেট আর অ্যরেঞ্জমেন্টের ছবি নির্মাণ করে সিনেমা হল বিমুখ দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংসের নীল নকশা তৈরি করা একটি অশুভ শক্তি জাজের কাজে অযৌক্তিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সিনেমা হল থেকে ফের দর্শক বের করে দেওয়া আর সিনেমা হল বন্ধের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে, যা কাম্য হতে পারে না।

সর্বশেষ খবর