শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ৫০ বছর

দীর্ঘ এই পথচলা মসৃণ ছিল না...

আলী যাকের

দীর্ঘ এই পথচলা মসৃণ ছিল না...

তিন দিনব্যাপী নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বর্ণাঢ্য উৎসব সম্প্রতি শেষ হলো। এই উৎসবের মাধ্যমে দলটি উদযাপন করল তাদের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর আর দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের ৪৫ বছর। এই উৎসব ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাট্যজন আলী যাকেরের সঙ্গে কথা বলেছেন— পান্থ আফজাল

 

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর আর দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সেইসব দিনের কথা জানতে চাই?

নাগরিকে প্রথম ৫ বছর আমি ছিলাম না। আমি ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেই। আর দর্শনীর বিনিময়ে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক প্রদর্শনের শুরুটা হয় ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে। সেই সময় আমি প্রথম নির্দেশনা দেই বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। কিন্তু দীর্ঘ এই পথ চলা মসৃণ ছিল না।

 

উৎসবে শেষ হলো। সবমিলিয়ে কেমন হয়েছে?

খুবই ভালো হয়েছে। প্রথমদিন ৩৯টি নাটকের মধ্য থেকে বাছাই করা ৭টি নাটকে অংশ নিয়ে ৮০ মিনিটের একটি মাল্টিমিডিয়ায় দেখানো হয়। পুরনো নাটক থেকে কিছু দৃশ্যের অভিনয় করা হয়। মহিলা সমিতি প্রাঙ্গণের বাইরে ও ভিতরে ছিল উৎসবমুখর। দলে সিনিয়র সদস্য হিসেবে সেদিন উপস্থিত ছিলেন আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াৎ, প্রফেসর ডা. আবদুস সেলিমসহ অনেকেই। নাগরিকের পুরনো-নতুন সব সদস্যের মিলনমেলায় উৎসব প্রাণ পেয়েছিল। উৎসবের শেষদিনে ‘দারিও ফো ও ফ্রাঙ্কা রামে’ রচিত ‘ওপেন কাপল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, যেটিতে অভিনয় করেন সারা যাকের আর জিয়াউল হাসান কিসলু। এদিন আমরা প্রফেসর ডা. আবদুস সেলিমকে নাগরিক মঞ্চায়িত ব্রেটল ব্রেশটের ‘গ্যালিলিও’ নাটকটির অনুবাদ করার জন্য সম্মাননা জানাই। বলতে গেলে, উদযাপনটি পরিপূর্ণ হয়েছে।

 

আপনার নির্দেশিত নাটকে তখন কে কে অভিনয় করেছিলেন?

‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে অভিনয় করেছিল সারা আমিন, যাকে আজকে সারা যাকের হিসেবে চিনে সবাই। আরও অভিনয় করেছিল ডা. নায়লা খান, আতাউর রহমান, বাদল রহমান, রশীদ হায়দার। এখন তো প্রতিদিন ঢাকা শহরে দর্শনীর বিনিময়ে কোনো না কোনো নাটক হচ্ছে। মানুষ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মঞ্চ নাটক দেখতে আসে—ভাবতেই ভালো লাগে।

 

সেই সময় নাটক মঞ্চায়নে সার্বিক অবস্থাটা কেমন ছিল?

সেই সময় মানুষ সন্ধ্যাবেলা বাইরে বের হতে ভয় পেত। তাই নাটক মঞ্চায়ন হতো সকালবেলা। আর রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আমরা বেলা ১১টা থেকে নাটক মঞ্চস্থ করতাম। মনে আছে, ওই সময়ে আমরা আটটা রবিবার ব্রিটিশ কাউন্সিলে হল বুক করে নাটক করেছিলাম। তবে ৮ রবিবার শেষ হওয়ার পর আমরা আর হল পাইনি। এরপর মহিলা সমিতিতে নাটক মঞ্চস্থ করার প্লান করি। পরে সারা যাকের জরাজীর্ণ মহিলা সমিতির পুরোটা ঝেড়ে-মুছে নাটক মঞ্চায়নের জন্য প্রস্তুত করে। এরপর কোনো এক রবিবারে আমরা মহিলা সমিতিতে প্রথমবারের মতো এই ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটিই মঞ্চস্থ করি।

 

পরবর্তীতে কোন নাটকটি নাগরিক মঞ্চস্থ করেছিল?

নাগরিকের দ্বিতীয় নাটক ছিল ‘বিদগ্ধ রমণীকুল ও তৈল সংকট’। এটিও আমি নির্দেশনা দিয়েছিলাম। মূলত দুটো নাটক মিলে তৈরি হয়েছিল নাটকটি। মলিয়রের রূপান্তরে প্রথম অংশ ‘বিদগ্ধ রমণীকুল’ ছিল ৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের। আর দ্বিতীয় অংশ  তৈল সংকট’ও ছিল ৪০ মিনিটের, যার নাট্যরূপ ও রূপান্তর করেছিলেন রশীদ হায়দার।

 

‘নাগরিকের ‘গ্যালিলিও’ সৃষ্টি না হলে আজকের আলী যাকের হতো না’—কথাটা কি সত্য?

প্রফেসর ডা. আবদুস সেলিমের অনুবাদে নাগরিক মঞ্চায়িত ব্রেটল ব্রেশটের ‘গ্যালিলিও’ নাটকটিতে আমি ‘গ্যালিলিও’ চরিত্রে অভিনয় করি। এই নাটকটি আমার পরিচয়। তাই এটি সৃষ্টি না হলে আজকের আলী যাকের হতো না।

 

নাগরিকের সামনের পরিকল্পনা কী?

সামনে নাগরিক-থিয়েটার যৌথভাবে নতুন একটি নাটক মঞ্চস্থ করবে। ডা. প্রফেসর আবদুস সেলিমের অনুবাদে ‘লাভ লেটার’ নাটকটিতে পাঠ অভিনয় করব আমি আর ফেরদৌসী মজুমদার। নির্দেশনা দেবে ত্রপা মজুমদার। এটি অবশ্য শাবানা আজমী আর ফারুক অভিনীত মঞ্চ নাটক ‘তুমহারি অমৃতা’-এর অনুবাদ। এটি মঞ্চস্থ করতে মাস খানেক সময় লাগবে।

 

নাগরিক ইদানীং খুব কম নাট্য প্রদর্শনী করছে...

ঠিক তা নয়। তবে অনেকদিন পর নাগরিক অনেকগুলো নাটক আবার ঢাকার মঞ্চে প্রদর্শন করেছে। মঞ্চস্থ করল ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা’, ‘গ্যালিলিও’, ‘নূরলদীনের সারা জীবন’, ‘মুখোশ’। আর আমার শরীর অনেকদিন ভালো ছিল না বলে অভিনয়েও অনিয়মিত ছিলাম।

 

‘বড় দলের প্রভাবে ছোট দল কম নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ পায়’-কথাটা কি সত্য?

আগে একটা সময় এই বিষয়টি ছিল। কিন্তু এখন কিছুটা হলেও কমেছে। এখন আমার জানা মতে, ছোট দল ১ মাসে ১টা দিন হল পায়। আবার এমনও হয়েছে, ছোট দলগুলো বড় দলগুলোর জন্য অডিটরিয়াম ছেড়ে দিয়েছে। আর হলের সংখ্যাও তো কম। আমরা কিন্তু বিশেষ দিবসে নাটক প্রদর্শনী করি না। তবে ছোট দলগুলোর ব্যাপারে ভাবা উচিত। আর পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ নাটকের জন্য হল হওয়া দরকার। আমি অবশ্য এই বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। আমরা বড় দলগুলোও এই বিষয়ে সঙ্গে থাকব সবসময়।

 

নাটক রূপান্তর করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন আবার লিখছেনও। সামনে আপনার লেখা কোনো বই আমরা পাব কি?

নাটক রূপান্তর, নির্দেশনা, লেখা-সবই হচ্ছে। এর আগেও আমি আমার আত্মকথন বের করেছিলাম। এখনো একটি দৈনিক পত্রিকায় আমি ‘মধ্যাহ্ন অপরাহ্ন’ নামে নাটকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছি। এটি অবশ্য সামনে পরিপূর্ণভাবে বই আকারে বের করার পরিকল্পনা আছে।

সর্বশেষ খবর