রবিবার, ২৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

মহরতেই ছবি শেষ...

আলাউদ্দীন মাজিদ

মহরতেই ছবি শেষ...

দীর্ঘদিন ধরে চলছে ছবি নির্মাণের নামে প্রতারণা। এই প্রতারণার নাম ‘মহরত সর্বস্ব ছবি’। এ ধরনের ছবির নাম এফডিসিতে এন্ট্রি করে হয় জমকালো মহরত। এরপর স্পন্সরের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অপরাধ করে থাকে এসব ছবির প্রযোজক নামধারী সংঘবদ্ধ একটি চক্র। প্রায় সময়ই দেখা যায় মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে নানা ফায়দা লোটে ওই নামধারী নির্মাতারা। এসব ছবি আর নির্মাণ হয় না। অনেক ছবির আবার লোক দেখানো কিছু শুটিংও হয়। এটি হয় বিশেষ করে স্পন্সরদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে অর্থ আদায় আর নায়িকাকে ভোগের জন্য। বেশির ভাগ মহরত সর্বস্ব ছবিতে লোভ দেখিয়ে নতুন মেয়ে আনা হয়। তারপর ভোগবিলাসেই সীমিত হয়ে যায় ছবি। এফডিসি বা পরিচালক সমিতিতে  শতাধিক এন্ট্রি সর্বস্ব ছবির নাম রয়েছে। এসব ছবির মধ্যে রয়েছে— চাইলাম যারে পাইলাম তারে, মন খোঁজে বন্ধন, মোনগর, জলে ভাসা পদ্ম, জালালের পিতাগণ, না মানুষ, হাডসনের বন্দুক, মুন এভিনিউ, এই তুমি সেই তুমি, প্রিয়তমা, আমি দাঁড়ি তুমি কমা, টাইম মেশিন, ফিল মাই লাভ, আসবো না ফিরে, লাভ ইন কোরিয়া, কিস্তির জ্বালা, ভালোবাসার চাইতে একটু বেশি, বিচার আমি করবো, লাইলী মজনু, আমার পিরানের কোনো মাপ নাই, আবার যোদ্ধা হব, তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা, প্রবাসীর প্রেম, সালাম মালয়েশিয়া, এলিয়েন এখন ঢাকায়, নষ্ট ছেলে, কেন আমি আসামি, বউ পাগল, কালো বিড়াল, পাগলের বিয়ে, মন যারে চায়, কাটা দাগ, মিশন সিআইডি, সাহসী কন্যা, নবীন কমিশনার, জনতার ডাক, নীলাঞ্জনা, সুন্দরী গুলবাহার, আদম, সবুজ কেন অপরাধী, আগুনমুখী, রক্তাক্ত প্রেম, প্রেমের নদী, নষ্ট হবার কষ্ট, বিয়ে হলো বাসর হলো না, মধুর জীবন, না বলা ভালোবাসা, এইতো সময় ভালোবাসার, হ্যালো অমিত, দুদু মিয়া, পারলে ঠেকা, শোয়া চান পাখি, আগুনের চোখে প্রেম, অন্তরে অন্তরে, ভালো লাগার চেয়ে একটু বেশি, প্রেমের কাজল, প্রক্সি চেক, প্রজন্ম এক্স, কর্পূর, টাকার খেলা, ষোলো আনা প্রেম, নায়িকা, একা একা, আল্লাহ রাখলে মারে কে, যষ্টিমধু, বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, জান্নাত থেকে জান্নাত, স্বজনহারা, আমরাও মানুষ, ভালোবাসা ছাড়া কেউ কী বাঁচে, মন আমার মন, প্রেমের অধিকার, দিঘি, প্রিয়া শুধু আমার, অফিসার, রঙিন পৃথিবী, তুমি কী আমার

ভালোবাসা, জটিল বন্ধন, কানামাছি, শতরূপে শতবার, সব কিছু পিছনে ফেলে, নীল মেঘ, অন্যরকম প্রেমকাহিনী, পায়রা মহুয়া, আউলা মন, আদি, মায়া, রাঙামন, গ্রেফতার, এবার তো হবে প্রেম, মিলন সেতু, নাকফুল, মনের মাঝে ভালোবাসা, তোকে বউ বানাবো, তোমার প্রেমে পড়েছি, সমসাময়িক, অনেক দৃষ্টি কেড়ে তুমি এলে, অসম প্রেম, প্রবাসীর প্রেম, না বলা ভালোবাসা, ব্ল্যাক পাওয়ার ইত্যাদি। ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট মহরত হয় রাকিবুল আলম রাকিবের ‘মনের রাজা’ ছবির, সাফিউদ্দিন সাফির  রাজকুমার চলচ্চিত্রের মহরত হয় ২০১৬ সালের ২৯ মে এফডিসিতে।  ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর মহরত হয় নিরঞ্জন বিশ্বাসের ‘জানেমান’ ছবির,  ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর মহরত হয় রাকিবুল আলম রাকিবের ‘মাঝির প্রেম’ ছবির, ২০১৬ সালে ‘আমি শুধু তোর হব’ চলচ্চিত্রের মহরত করেন রফিক শিকদার। ফেরদৌস ও সোহানা সাবাকে নিয়ে শুরু হয়েছিল শাহানূর রিপনের প্রাচীর পেরিয়ে ছবির কাজ। ২০১৬ সালেই  আবদুল মান্নান মহরত করেছিলেন প্রেমে অনেক জ্বালা ছবির। বিগ বাজেটের চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল দোস্ত দুশমন চলচ্চিত্রের। লন্ডনপ্রবাসী পরিচালক বি কে আজাদ দেশে এসে ঘটা করে মহরত করেছিলেন। ২০১৬ সালে পরীমনি, জায়েদ খান ও আসিফ নূরকে নিয়ে ত্রিভুজ প্রেমের চাঁদনী ছবির মহরত করেন পরিচালক শামিমুল ইসলাম। সেই ছবির শুটিংয়ের কোনো খবর নেই। জায়েদ খান, সাইমন ও নবাগত সানাইকে নিয়ে পরিচালক গাজী মাহবুব ভালোবাসা ২৪–৭ নামে একটি ছবি তৈরির ঘোষণা দেন। ২০১৬ সালের ২০ মে এফডিসির মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্সে মহরত হলেও সেই ছবির শুটিং শুরু হয়নি আজও। সাইমন সাদিক ও নবাগত নওরীনকে নিয়ে এফডিসিতে রকিবুল আলম প্রেমিক ছবির মহরত করেন ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট। আজ পর্যন্ত এ ছবির শুটিং হয়নি। সাইমন সাদিক ও সানাইকে নিয়ে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রতিশোধ ও প্রতীক্ষা নামে একসঙ্গে দুটি ছবির মহরত করেন মুস্তাফিজুর রহমান বাবু। সে ছবির শুটিং আজ পর্যন্ত হয়নি। একই পরিচালকের হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা ছবিটির মহরত হয় গত বছরের ২২ অক্টোবর, উত্তরায়। জায়েদ খান, পরীমনি ও শিরিন শিলাকে নিয়ে ছবির অল্প অংশের শুটিংও হয়। এরপর দীর্ঘদিন ছবিটির শুটিং বন্ধ। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সুমন দে বাপের দোয়া কি কম দামি নামে একটি ছবির ঘোষণা দেন। তারও কোনো খবর নেই।

২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে প্রধান অতিথি করে মহরত করা হয় অচেনা পৃথিবী নামের একটি ছবির। ছবির নায়ক-নায়িকা বাপ্পী ও জলি। ছবির পরিচালক সালমান বিন আকরাম। ওই ছবির শুটিং শুরু না করেই ২৬ আগস্ট একই জুটিকে নিয়ে ওই পরিচালক ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় রাজ-দ্য নিউ সুলতান নামে আরেকটি ছবির মহরত করেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মহরত হয় ‘টিকলী’ ছবির,সংশ্লিষ্ট প্রযোজক-পরিচালকরা বলেন কিছু সমস্যা হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। কিন্তু মাস বছর যুগ পেরিয়ে গেলেও কাজ আর শুরু হয় না। হয় শুধু চাঁদাবাজি আর ভোগবিলাস।

চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ দাবি করেন, এটি এক ধরনের মন্দ ব্যবসা। প্রযোজক বাগিয়ে এনে মহরত করে নানা অনৈতিক কাজের আশ্রয় নেওয়া হয়। এ অবস্থা রোধ করতে হলে নির্মাণ এবং এ ক্ষেত্রে নানা নিয়মনীতি বাধ্যতামূলক করতে হবে এফডিসি এবং চলচ্চিত্র সমিতিগুলোর। না হলে কিছু বাজে মানুষ চলচ্চিত্র নির্মাণের নামে নানা অপরাধ করে বেড়াতেই থাকবে।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহ-সভাপতি মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, এগুলো একদিকে লোক দেখানো কাজ, মানে জমকালো মহরত করে ছবি শেষ না করা। অন্যদিকে প্রযোজকের টাকা খসানোর জন্য মন্ত্রী এনে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে প্রযোজককে প্রলুব্ধ করা। এরা হচ্ছে মহরত ডাইরেক্টর। এমন অসাধু লোকের জন্য সত্যিকারের প্রযোজকের মনে চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্মায় এবং লগ্নিকারক পাওয়া যায় না। এদের হাত থেকে চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতেই হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব চলচ্চিত্র নির্মাতা বদিউল আলম খোকন বলেন, একটি প্রবাদ আছে, ‘খালি কলস বাজে বেশি’। যারা মহরতেই ছবি শেষ করে তাদের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে। মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে যে কোনো ফায়দা লোটে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর