শিরোনাম
রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঢাকাই ছবির সেই রানী সরকার

ঢাকাই ছবির সেই রানী সরকার

জন্ম : ১৯৩২ সাল, মৃত্যু : ৭ জুলাই, ২০১৮

ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত অভিনেত্রী রানী সরকার অধ্যায়ের অবসান ঘটল। গতকাল ভোর ৪টায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন তিনি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী পঞ্চাশের দশক থেকে বড় পর্দায় অভিনয় শুরু করেন। আশির দশক পর্যন্ত বড় পর্দায় দাপিয়ে অভিনয় করলেও নব্বই দশক থেকে কাজের অভাব ও অসুস্থতা এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যায়। চরম দুঃখ দুর্দশায় কাটে তার অসহায় জীবন। রানী সরকারের জীবন নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আমিরুন নেসা থেকে অভিনেত্রী রানী সরকার

রানী সরকারের প্রকৃত নাম মোসাম্মৎ আমিরুন নেসা খানম। ডাক নাম ছিল মেরী। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানার সোনাতলা গ্রামে ১৯৩২ সালে জন্ম তার।  পিতার নাম সোলেমান মোল্লা এবং মাতা আছিয়া খাতুন। সাতক্ষীরার সোনাতলা গ্রামের ইউপি স্কুল থেকে প্রাথমিক পাঠক্রম শেষ করেন। এরপর খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। চলচ্চিত্রে এসে আমিরুন নেসা হয়ে যান রানী সরকার। মূলত খল অভিনেত্রী ছিলেন রানী সরকার।

অভিনয় জীবন

রানী সরকারের অভিনয় জীবন শুরু করেন ১৯৫৮ সালে বঙ্গের বর্গী মঞ্চনাটকের মাধ্যমে। এই বছরই তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ জে কারদার পরিচালিত ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এহতেশামুর রহমান পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’তে অভিনয় করেন। এতে তিনি ছবির নায়িকা শবনমের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রের নির্মাতা এহতেশাম তাকে রানী সরকার নামে অভিনয় করান।  চান্দার সাফল্যের পর জনপ্রিয়তার সঙ্গে অর্ধ সহস্রাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে তালাশ, বন্ধন, সঙ্গম, ইম ধরতি পার, আজান, কাঁচের দেয়াল, কাঁচ কাটা হীরে, বেহুলা, আনোয়ারা, ছদ্মবেশী, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, তিতাস একটি নদীর নাম, চন্দ্রনাথ, শুভদা, দেবদাস, আয়না প্রভৃতি। রানী সরকার অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হচ্ছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার’। তিনি ছোট পর্দার বেশ কয়েকটি নাটকেও জীবন সায়াহ্নে এসে অভিনয় করেন। তার সর্বশেষ অভিনীত নাটক ছিল ডি এ তায়েবের ‘ডিবি’।

 

জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ তে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় রানী সরকারকে।

 

যেভাবে চলে গেলেন রানী সরকার

গত প্রায় দেড় যুগ ধরে কাজের অভাবে অসহায় ও নিঃস্ব হওয়ায় হতাশ রানী সরকারের শরীরে ধীরে ধীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। পিত্তথলির পাথর, বাতজ্বর, জটিল কোলেলিথিয়েসিস  রোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।   মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং মোড়ের ৬ নম্বর বাসায় মৃত ভাইয়ের দুটি এতিম মেয়েকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটছিল তার। ২০১৪ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানী সরকারকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দেন। এই অর্থ সরকারিভাবে ব্যাংকে এফডিআর করে দেওয়া হয়। সেই অর্থ থেকে ইন্টারেস্ট হিসেবে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে পেতেন তিনি। এই টাকার মধ্যে ১৩ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতেন তিনি। বাকি ৭ হাজার টাকা দিয়ে মৃত ভাইয়ের দুই মেয়ে এক পঙ্গু ভাই এবং নিজের খাওয়া-দাওয়া করাই ছিল দায়। ফলে সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। অনবরত রোগ ভোগ করছিলেন। শনিবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাত সাড়ে ১২টায় প্রথমে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তার অবস্থা জটিল হওয়ায় চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর তাকে ইডেন মাল্টি কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৪টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী।

 

কেউ খবর রাখেনি তার

ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত এই অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করলেও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও অন্যান্য চলচ্চিত্র সংগঠন এবং চলচ্চিত্র নির্মাতারা তার আকুতি মিনতি সত্ত্বেও তাকে কোনো কাজ দেননি এবং তার দিকে ফিরেও তাকাননি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শোবিজ বিভাগে তার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে ‘আমি বাঁচতে চাই’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করলে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর তাকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন এবং আরও অনেকে তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। কিন্তু এই সাহায্য অপ্রতুল হওয়ায় তার অসহায়ত্বের অবসান হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শোবিজ বিভাগ ‘রানী সরকারের আক্ষেপ’ শিরোনামে আরেকটি খবর প্রকাশ করলে শিল্পী ঐক্যজোটের সভাপতি প্রখ্যাত অভিনেতা ডি এ তায়েব এবং সাধারণ সম্পাদক জি এম সৈকত জোটের উদ্যোগে রানী সরকারকে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংবাদ ও শিল্পী ঐক্যজোটের সংবাদ সম্মেলনের পর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।

 

ফিরতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রে

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বনভোজনে গিয়েছিলেন রানী সরকার। এটিই ছিল চলচ্চিত্রের কোনো অনুষ্ঠানে তার শেষ যাওয়া। ওই দিন অঝোরে কেঁদে তিনি বলেছিলেন, এভাবে ভাতের অভাবে কাঁদতে হবে কোনোদিন ভাবিনি। দিনটা শুরু হয় ভাতের অভাব দিয়ে। চাল থাকে তো নুন থাকে না। এভাবে জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে বুঝতে পারছি না। কারও বাসায় গেলে চা বিস্কুট খাওয়ায়, ভাত  দেয় না কেউ। চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, সবাই আমাকে চেনে, যে কারণে ভিক্ষা করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমার সংসার চলে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টাকায়। আবার চলচ্চিত্রে কাজ করতে চাই। আমাকে কাজ  দেন। কাজ পেলে অন্তত কটা টাকা পাব, সেই সময়টা ভালো খেতে পারব, কিছু টাকা পেলে বাড়িতেও দুদিন খাবার হবে। রানী সরকারের গ্রামের বাড়ি সোনাতলা গ্রামে ভিটেমাটি ছাড়া এখন আর কিছু নেই। সেটা দেখাশোনা করেন তার ভাতিজা মিজান।

 

সুখের গ্রাম দূরেই রয়ে গেল

রানী সরকার অভিনীত প্রথম ছবির শিরোনাম ছিল ‘দূর হ্যায় সুখ কি গাঁও’। মানে সুখের গ্রাম অনেক দূরে। ছবির নামের মতো বাস্তব জীবনেও সুখের গ্রাম দূরে রয়ে গেল। শেষ জীবনটা চরম দুঃখ কষ্টেই কাটল। শিল্পী সমিতির বনভোজনে তিনি বলেছিলেন, অনেকদিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না। বাড়ির জন্য মনটা কেন জানি বেশি কাঁদছে। শীত শেষ হলেই যাব। কিন্তু বিধিবাম! তার আর সেই সুখের গ্রামে যাওয়া হলো না। মানে সুখের গ্রাম দূরেই রয়ে গেল।

 

শেষ শ্রদ্ধা...

সকালে হাসপাতাল থেকে রানী সরকারের মরদেহ নিয়ে আসা হয় মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসায়। তখন প্রতিবেশীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। চলচ্চিত্রের লোকজনকে তেমন একটা দেখা যায়নি। হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, লাশবাহী গাড়ির ভাড়া দেয় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। আর দাফনের খরচ বহন করেন প্রয়াত এই অভিনেত্রীর ভাতিজা মিজান। আর সার্বক্ষণিক তদারকি করেন শিল্পী ঐক্যজোটের সভাপতি ডি এ তায়েব এবং সাধারণ সম্পাদক জি এম সৈকত। গতকাল বাদ জোহর মোহাম্মদপুর নবোদয় জামে মসজিদে প্রথম, দুপুর ২টায় চ্যানেল আই ও বিকাল ৩টায় এফডিসিতে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আজিমপুর গোরস্তানে অন্তিম শয়ানে শায়িত হন বরেণ্য এই অভিনেত্রী রানী সরকার।

 

সহকর্মীদের শোক গাথা...

সুচন্দা

রানী সরকার ছিলেন একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র জগত তাকে সঠিক মূল্য দিতে পারেনি। এটি আমাদের এই জগতের চরম ব্যর্থতা। না হলে তার মতো একজন প্রখ্যাত অভিনেত্রীর শেষ জীবনটা এমন কষ্টের হবে কেন? সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। এটি নিয়তির অমোঘ বিধান। রানী আপা চিরদিন আমাদের মাঝে  বেঁচে থাকবেন তার দক্ষ কাজের মাঝে।

 

মীরানা জামান

রানী সরকার এবং আমার পথচলা প্রায় একই সময়ে। রেডিওতে সিনেমাতে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি। অনেকটা সময় পর্যন্ত  একসঙ্গে ছিলাম। রানীর সঙ্গে শেষ দেখাটা হলোই না। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন।’

 

শবনম

রানী আপার সঙ্গে চান্দা ছবিতে আমার প্রথম কাজ। এরপর  একসঙ্গে ‘তালাশ’সহ আরও বহু ছবি। একজন নিবেদিনপ্রাণ অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা ছিল শেষ সময় পর্যন্ত। আমাকে ঝরনা বলেই ডাকতেন। খুউব আদর করতেন। একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন আমার শুরুর সময়ের। রানী দিদিও চলে গেলেন। আরও একা হয়ে গেলাম।

 

আনোয়ারা

অভিনেত্রী হিসেবে রানী সরকারের মতো দ্বিতীয় আর কোনো শিল্পী আসবে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু আমরা তাকে যথাযথ সম্মান আর মূল্যায়ন করতে পারিনি। তার শেষ জীবনটা এতটা কষ্টে কাটবে তা কখনো কল্পনা করার মতো নয়। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

প্রবীর মিত্র

একের পর এক সিনিয়ররা সবাই চলে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কি হতে পারে। জানি জীবনটা মৃত্যুর জন্যই। তারপরেও এই চরম সত্যটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। তার সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। তার আন্তরিকতা ও কাজের প্রতি ভালোবাসার কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না। এমন গুণী শিল্পীর যেন আর অসহায় মৃত্যু না হয় সেটাই প্রার্থনা করছি।

সর্বশেষ খবর