সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের সেই সোহেল রানা

চলচ্চিত্রের সেই সোহেল রানা

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অন্যতম জীবন্ত কিংবদন্তি মাসুদ পারভেজ। সোহেল রানা নামেও পরিচিত ও জনপ্রিয় তিনি। ঢাকাই ছবির বেশ কজন তারকা দক্ষ কর্মযজ্ঞ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে আলোকিত করে রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম এক নক্ষত্রের নাম মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা— সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। তার ব্যক্তিগত, চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক জীবনের কথা তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ, ছবি : রাফিয়া আহমেদ

 

মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে মাসুদ পারভেজ ও তার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলেন কী করবেন? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। তারা ভাবলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সেই ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম লেখালেন মাসুদ পারভেজ। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবির মাধ্যমে। তার স্বনামধন্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হলো ‘পারভেজ ফিল্মস’। ‘ওরা ১১ জন’ ছবির কাহিনী রচনা করলেন আল মাসুদ। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে হয়ে গেলেন নায়ক। ‘মাসুদ রানা’ শিরোনামের ছবিতে নায়ক হিসেবে অভিষেক তার। মজার ব্যাপার হলো ‘মাসুদ রানা’ ছবির প্রধান চরিত্রের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। চরিত্র নির্বাচনের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এসএম শফি, অভিনেত্রী সুমিতা দেবী, মাসুদ পারভেজ আর চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। সারা দেশ থেকে অনেকেই ছবি পাঠালেন মাসুদ রানা চরিত্রটির জন্য। কিন্তু ঘটল মজার ঘটনা। এসএম শফি, সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরী হঠাৎ একদিন মাসুদ পারভেজকে বললেন, ‘তুমিই হবে মাসুদ রানা।’ আহমেদ জামান চৌধুরী তখনই নায়ক হিসেবে তার নাম ঠিক করলেন ‘সোহেল রানা’। এরপর আহমদ জামান চৌধুরীই তাকে ড্যাশিং হিরো উপাধি দেন। এই ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা তাকে পর্দায় দেখতে পান ১৯৭৪ সালে। তার পরিচালিত প্রথম ছবি হচ্ছে ‘এপার ওপার’। এই ছবির মাধ্যমেই তিনি প্রথম একসঙ্গে নায়ক ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এপার ওপার’-এ তার নায়িকা ছিলেন সোমা মুখার্জি। ‘এপার ওপার’ ছবি সম্পর্কে একটি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এপার ওপার’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য দুই-তিনজন নায়িকা সিডিউল দিতে পারল না।  সেই মুহূর্তে সুমিতা দেবী কলকাতার সোমা মুখার্জির কথা জানালেন। তিনিই সোমাকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করলেন। সোমার বাবা সোমাকে নিয়ে সরাসরি সিলেটের  জৈন্তাপুরে চলে এলেন। সেখানেই সোমাকে প্রথম দেখলাম। বেশ পছন্দ হলো। তাই সোমাকে নায়িকা হিসেবে নিলাম।’ সোহেল রানার প্রথম নায়িকা কবরী ও অলিভিয়া। ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে এরা দুজন তার বিপরীতে ছিলেন। সোহেল রানা ও ববিতা জুটি এক সময় জনপ্রিয় হয়েছিল। এই জুটির ‘গুনাহগার’ ছবিটি ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায়। এরপর ববিতার সঙ্গে অভিনয় করেন আরও বেশ কটি ছবিতে। সোহেল রানা প্রযোজিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে শাবানা অভিনয় করেছিলেন।  এরপর শাবানার সঙ্গে ‘রাজরানী’, ‘জবাব’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। সুচরিতা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনা প্রমুখ নায়িকার বিপরীতে ছিলেন সোহেল রানা। তার প্রযোজিত ছবিগুলো হলো- গুনাহগার, জবাব, এপার ওপার, জীবন নৌকা, যাদুনগর, নাগপূর্ণিমা, মাকড়সা, লড়াকু, বীরপুরুষ, বজ্রমুস্টি, ঘেরাও, চোখের পানি, টপ রংবাজ, ঘরের শত্রু, শত্রু সাবধান, ভালবাসার মূল্য কত, রিটার্ন টিকিট, মায়ের জন্য পাগল প্রভৃতি। ৩৫টি ছবি প্রযোজনা এবং অর্ধশত ছবি পরিচালনা করেন তিনি। অভিনয় করেন প্রায় পৌনে তিনশত ছবিতে। একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন সোহেল রানা। আশির দশকে বাংলাদেশের দর্শকরা ভিডিও-ভিসিপির মাধ্যমে যখন হলিউডের মার্শাল আর্টভিত্তিক ব্রুসলির ছবির ভক্ত হয়ে পড়ে তখন সোহেল রানা ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে দিয়ে নির্মাণ করেন মার্শাল আর্টভিত্তিক ‘রক্তের বন্দী’ ছবিটি। এরপর ছোট ভাই রুবেলকে নায়ক করে শহিদুল ইসলাম খোকনকে দিয়ে নির্মাণ করেন ‘লড়াকু’ ছবিটি। যা বক্স অফিসে ঝড় তোলে আর বাংলার দর্শকরা দেশীয় মার্শাল আর্টভিত্তিক ছবি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। বাংলা চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্ট ও কুংফুর প্রবর্তক হলেন সোহেল রানা। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা এতটাই জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার যে, সিনেমার পোস্টারে মাসুদ পারভেজ/সোহেল রানা এই দুটি নামের যে  কোনো একটি থাকলেই সেই ছবি দেখতে দর্শক সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রের নানা সংগঠনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে এই অঙ্গনে প্রাণ সঞ্চার করেন মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রযোজক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি।

এ ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, দুইবার প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, দুইবার পরিচালক সমিতির সভাপতিসহ নানা সময়ে চলচ্চিত্রের কল্যাণে অপরিসীম ভূমিকা রাখেন তিনি। চলচ্চিত্র শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা তৈরিতেও তার অবদান অবিস্মরণীয়। শিল্পী রুবেল, অঞ্জনা, ড্যানি সিডাকসহ অনেক জনপ্রিয় তারকা, কণ্ঠশিল্পী আজাদ রহমান, সেলিনা আজাদ, ক্যামেরাম্যান হাসান, চিত্র সম্পাদক জিন্নাতসহ অনেকেই তার মাসুদ পারভেজের হাত ধরে এই অঙ্গনে আসেন ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখনো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একজন মাসুদ পারভেজ  সোহেল রানার অপেক্ষায় থাকে, যিনি দক্ষ কর্মযজ্ঞ আর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বহুদূর, উজ্জ্বল সূর্যের নিচে চির সোনালি দিনে।

 

রাজনৈতিক জীবন

১৯৬৩ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন মাসুদ পারভেজ। তখন তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ওই সময় দুটি রাজনৈতিক দল ছিল— একটি ছাত্র ইউনিয়ন অপরটি ছাত্রলীগ। ১৯৬৫-তে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বৃহত্তর ময়মনসিংহের। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন  ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যথেষ্ট অবদান ছিল তার। মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে কামরাঙিরচরে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করেন। প্রায় ৪০ বছর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে দেশ গড়ায় ভূমিকা রাখেন। ২০১০ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমন্ত্রণে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি। এখনো জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় আছেন মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা।

 

ব্যক্তিগত জীবন

মাসুদ পারভেজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়। তার জন্ম ঢাকায় হলেও পৈতৃক বাসস্থান বরিশাল জেলায়। তার স্ত্রী ডা. জিনাত পারভেজ এবং একমাত্র সন্তান মাশরুর পারভেজ জীবরান। পুত্র জীবরানও চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রযোজক কামাল পারভেজ ও নায়ক রুবেল তার ভাই। সোহেল রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। পরে এলএলবি করেন।

সর্বশেষ খবর