শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঝিমিয়ে পড়েছে পথনাটক

ঝিমিয়ে পড়েছে পথনাটক

সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অর্জন পথনাটক। কিন্তু বর্তমানে পৃষ্ঠপোষকতা ও সদিচ্ছার অভাবে পথনাটক প্রদর্শনী অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে পথনাটক এবং এর আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেনে— পান্থ আফজাল

 

১৯৭৭ সালে ঢাকা থিয়েটার সেলিম আল-দীন রচিত ‘চর কাঁকড়ার’ ডকুমেন্টারি নামে প্রথম পথনাটক ঢাকায় প্রদর্শন করে। পরে পদাতিক নাট্য সংসদ এস এম সোলায়মান রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল’ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ করে। আশির দশকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পথনাটক উৎসব পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৮৭ সালে ঢাকার নাট্যদল মহাকাল, সুবচন, গণছায়া, মহানগরী ’৭৭ একত্রিত হয়ে নিয়মিত পথনাটক প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেয়। সে সময় মোট ২৫টি নাট্যদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাত দিনব্যাপী পথনাটক প্রদর্শনী করে। ১৯৭১ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং আজও গণমানুষের সংগ্রামী হাতিয়ার এই পথনাটক। পথনাটক এই সময়টাতে নাট্যকর্মীদের যতটুকু সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে উঠেছিল, মঞ্চনাটকে দু-একটি উল্লেখযোগ্য নাটক ছাড়া সেরকম কোনো বিষয় তখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠেনি। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ও সদিচ্ছার অভাবে পরবর্তীতে আস্তে আস্তে পথনাটক প্রদর্শনী স্তিমিত হয়ে পড়ে।

পথনাটক শুধুমাত্র বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ভূত এক ধরনের নাট্যশৈলী তা নয়। নাটকে কি বলতে চাইছি, কেন বলতে চাইছি, কাকে বলতে চাইছি এগুলো পথনাটকের উৎস এবং ভিত্তি। সেই কারণেই পথনাটক শুধুমাত্র গবেষণাগারপ্রসূত একটা অভিনব নাট্যশৈলী নয় এটা পথে মাঠে ঘাটে পরীক্ষিত যুগের ও সমাজের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এক আন্দোলন। সমাজের সচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত পালাবদলের ইতিহাস প্রবাহমান হয়েছে বাংলাদেশের পথনাটকে। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি পথনাটকেও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছিলেন নাট্যকর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে পথনাটক হতো। সেই সময় মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগানোর হাতিয়ার ছিল এটি। পরবর্তীতে আমাদের নাটকের নির্মাণ ও অভিনয় প্রয়োগে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের আবির্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এর চর্চা, গড়ে ওঠেনি পথনাটকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দল। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘পথনাটক হচ্ছে। তবে সেই ’৮০ বা ’৯০ দশকে যে মুখরতা ছিল তা এখন স্তিমিত হয়ে গেছে।  কোনো রকম ইস্যু ছাড়া পথনাটক হচ্ছে। নানা রকম অজ্ঞাত কারণে কেউ মুখ খুলছে না। একসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পথনাটক লিখেছি, করেছি। এখন কেউই কোনো ইস্যু নিয়ে লিখছে না।’ বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা বলেন, ‘পথনাটকগুলো শীত মৌসুমেই নিয়মিত হয়। পথনাটক নিয়ে নিয়মিত উৎসব হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের উদ্যোগে পথনাটক উৎসব হয়। অনেক হচ্ছে, তবে নীরবে-নিভৃতে হওয়ার কারণে পথনাটকের কার্যক্রম তেমন করে চোখে পড়ে না। আর এখন কম দৃশ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার কারণে।’

পথনাটকের আন্দোলনকে তুলে ধরে নাট্যজন ড. ইনামুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী পথনাটক হতো। ওই সময় রবীন্দ্রনাথের নাটক-গান প্রচারের ওপর তৎকালীন মোনায়েম সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই বিধি-আরোপের মুখেও আমরা বিভিন্ন মঞ্চ ও পথনাটক মঞ্চস্থ করতে পিছু হটিনি। এখনো হচ্ছে তবে চোখে পড়ছে না তেমন করে।’

নাট্যজন আবুল হায়াত বলেন, ‘পথনাটক যে হচ্ছে না তা বলা যাবে না। হচ্ছে অনেক কিন্তু আকাশ সংস্কৃতি ও মিডিয়ায় প্রচারের অভাবে এর কার্যক্রম ঢাকা পড়ে গেছে। স্বাধীনতা পূর্ব ও পরে পথনাটক অনেক হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এক সময় তো আমরা নাটক দিয়েই আমাদের আন্দোলন চালিয়েছি।’ পথনাটকে আয়ের সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোটায় থাকায় এই নাটক পরিচালনায় ও প্রদর্শনীতে এখন তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না মঞ্চনাটক সংগঠনগুলো। তাই ধীরে ধীরে সভ্যতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলাদেশের পথনাটকের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান কার্যক্রম। বাংলাদেশের পথনাটকের অতীত ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে সবার প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে মঞ্চনাটকের কর্তাব্যক্তিদের। থিয়েটারের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রয়াসই পারে পথনাটকের অতীত ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর