রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্র হারিয়েছে যেসব গল্প ও চরিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্র হারিয়েছে যেসব গল্প ও চরিত্র

১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল ঢাকার প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। মূলত একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল একটি পারিবারিক গল্পের ছবি। এতে নানা চরিত্রের উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। মোটকথা একটি সমৃদ্ধ গল্প ও চরিত্রের ছবি বলে দর্শক সাদরে গ্রহণ করে ছবিটি। এই ধারাবাহিকতায় একে একে নির্মিত হতে থাকে আকাশ আর মাটি, মাটির পাহাড়, এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, কখনো আসিনি, সূর্যস্নান, সুতরাং, নয়নতারাসহ প্রচুর গল্প ও চরিত্র সমৃদ্ধ ছবি। একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো—  নানা, নানী, দাদা, দাদি, মা, বাবা, ভাই বোন, প্রেমিক প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। আর এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এতে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে উপভোগ করত ছবিটি। এ কারণেই ৫০ থেকে আশির দশকের চলচ্চিত্রের ছিল সোনালি সময়। এ সময় ফোঁক, নারীর যন্ত্রণা ক্লিষ্ট চিত্র, প্রেম, গ্রাম্য মোড়লের আধিপত্য থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকদের মনে চলচ্চিত্রকে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হতো। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়ন মণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতি, ছুটির ঘণ্টা, ডুমুরের ফুল, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, নাত বৌ, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা প্রভৃতি। সালাউদ্দিন নির্মিত রূপবান ফোঁক ছবি হলেও এতে একজন নারীর জীবন যন্ত্রণা দর্শকদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করেছে। এ ছবিতে শুধু রাজা রানীর গল্প বলা হয়নি। পারিবারিক চিত্রের পূর্ণতা ছিল। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও এখানে পরিবারের বিভিন্ন সমস্যার কথা মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে আলোরূপী ববিতার ছিল নানা নারায়ণ চক্রবর্তীর আদরের নাতনি। যে কিনা ভোরে জেগে উঠে সবার মুখে চা তুলে দিয়ে ঘুম ভাঙাত। একসময় যুদ্ধের দামামা প্রাণ কেড়ে নেয় আলোর। এ ছবিতে আলো তার প্রাণ দিয়ে নতুন করে দেশ গড়ার মিছিলের অনুপ্রেরণা জোগায়। চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হলেও এই ছবিতে কয়েকটি পরিবারের যন্ত্রণার গল্প স্থান পায়। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একজন বীরাঙ্গনা নারীর গল্প বলে থেমে যায়নি। এখানে সাংবাদিকরূপী আনোয়ার হোসেনের বিবেকের দহন দর্শকের মন পুড়িয়েছে। খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ শুধু একটি ছবি ছিল না, এটি ছিল সমাজ সংস্কারের দর্পণ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অভাব অনটনে পোড় খাওয়া সমাজে হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা যখন অপরাধ করতে অস্ত্র হাতে তুলে নেন তখন তাদের কলেজের অধ্যক্ষ তাদের মানুষ হওয়ার মন্ত্রণায় দীক্ষিত করে মানুষ হওয়ার পথ দেখায়, হতাশা মুক্ত করে। আমজাদ হোসেন এগিয়ে এলেন গ্রাম্য কুসংস্কার আর মোড়লের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক তরুণের প্রতিবাদী গল্প নিয়ে। ছবির নাম নয়ন মণি। এতে প্রেম আর পারিবারিক আবহ, কৌতুকসহ একটি পরিপূর্ণ জীবন চিত্র ফুটে ওঠে এবং দর্শকদের মুগ্ধ করে। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নারীর দুঃখ প্রধান চলচ্চিত্র হলেও এখানে মোড়লের অত্যাচার, সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র দর্শকদের এসব বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। একইভাবে এই নির্মাতার ‘ভাত দে’ ছবিটিতে সমাজপতি রূপী মজুতদারদের অত্যাচারে কৃত্রিম অভাব অনটন সৃষ্টি হওয়ার ঘৃণিত চিত্র বিকশিত হয়েছে। কাজী জহিরের অবুঝ মন এবং ময়নামতি ছিল প্রেমের ক্ষেত্রে পারিবারিক টানাপোড়েনে নির্মিত সমাজ চিত্রের বিমূর্ত একটি চিত্ররূপ। আজিজুর রহমানের ছুটির ঘণ্টা, অশিক্ষিত, সুভাষ দত্তের ডুমুরের ফুল, খান আতার ডানপিটে ছেলে আর সালাউদ্দীন জাকির এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী মূলত শিশুতোষ চলচ্চিত্র হলেও এসব ছবিতে সমাজ এবং পারিবারিক সচেতনতামূলক বাণী জীবন্ত হয়েছে। জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবি রাজনৈতিক গল্পকে জীবনের মোড়কে আচ্ছাদিত করেছে। কামাল আহমেদের অশ্রু দিয়ে লেখা, নজরুল ইসলামের স্বরলিপি, ছটকু আহমেদের নাত বৌ ছবিগুলোতে প্রেম, পরিবার, বিনোদন দর্শকদের বিমোহিত করেছে। খান আতার সিরাজদ্দৌলা এবং সুভাষ সোমের সাত ভাই চম্পা চলচ্চিত্রে ঐতিহাসিক এবং রূপকথার অভাব পূরণ করেছে। আশির দশক পর্যন্ত এ জাতীয় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র প্রচুর পাওয়া গেছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন আমাদের দেশে ভিসিআরএ হিন্দি ছবি দেখা শুরু করে। আর কতিপয় নির্মাতা এসব মৌলিক গল্প বিবর্জিত ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে অ্যাকশন ছবির নামে মারদাঙ্গা গাঁজাখোরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তির উৎপাদন করে। এই অবস্থা এখনো চলছে। মাঝে মধ্যে দু-একটি পারিবারিক গল্পের জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছবিতে পরিবার আর গল্প খুঁজে পাওয়া যেত। আর তাতে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে দর্শক সিনেমাহলে ভিড় করত। এখনকার ছবিতে গল্প আর চরিত্রের সংকট। এখন ছবিতে আর নানা নানি দাদি তো দূরে থাক মা- বাবাই থাকে না। কমেডির নামে ভাঁড়ামি আর জোর করে দর্শক হাসানোর অপচেষ্টা চলে। আগে কমেডিয়ানরাও ছিল রীতিমতো তারকা। ছবিতে চরিত্র কমে গেছে। একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক আর আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, এখনকার ছবিতে গল্পই তো নেই চরিত্র থাকবে কীভাবে। বর্তমানে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে এক ধরনের মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছে তাতে যাপিত জীবনের উপকরণ নেই। এসব গল্প ও জীবনবোধের ছায়াহীন ছবি দর্শক কেন দেখবে।

 

সর্বশেষ খবর