রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গান চলে গেছে শুধুই ইউটিউবে

গান চলে গেছে শুধুই ইউটিউবে

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গান শোনা বা দেখার মাধ্যমে চলে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। অনেকেই একে বলছেন ‘ডিজিটাল গানের যুগ’। একটা সময় ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এরপর সিডি প্লেয়ারে গান শোনা শুরু হলে দ্রুত হারিয়ে যায় ‘ক্যাসেট যুগ’। কিন্তু বর্তমানে এসব কিছুকে ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে অনলাইনে গানের প্রকাশনা। তার মধ্যে মিউজিক ভিডিওর জন্য জনপ্রিয় হয়েছে ইউটিউব। সম্প্রতি ইউটিউব ছেয়ে গেছে মানহীন মিউজিক ভিডিওতে। এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকারের সঙ্গে। তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন—  আলী আফতাব

 

আলাউদ্দীন আলী

ইউটিউব গান শোনা বা দেখার একটি আধুনিক মাধ্যম। গান তো দেখার জিনিস না, এটা শোনার। ১০ কোটি লোক একটা গান শুনল বা দেখল, সেটা গুরুত্বের চেয়ে যদি ১০ জন লোক শুনে মনে করে যে গানটা গাইতে পারে তাহলে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা না হয়ে যদি একটা গান ১০ কোটি, ৫০০ কোটি কিংবা গোটা পৃথিবীর লোকও শোনে বা দেখে তাহলে কোনো লাভ নেই। খারাপ জিনিস মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখে। আর গান দেখা এক জিনিস, শোনা আরেক জিনিস এবং মনে রাখা আরেক জিনিস। গান হলো কানের শান্তি, মনের শান্তি। দেখবেন, অন্ধ লোকেও গান গায়, গান শোনে। একজন অন্ধ লোক যখন ট্রেনে চড়ে ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’ গানটি গেয়ে ভিক্ষা করে, সেটা তো মনে গেঁথে যাওয়ার কারণেই। গানের ভিউটাকে সামনে না এনে গানটাকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। এ ধরনের প্রচার থেকে সবাইকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।’

 

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

একটি গানের মূল বিষয় হচ্ছে কথা, সুর ও সংগীত। এই তিনটি বিষয় যদি সঠিক হয় গান জনপ্রিয় হবেই। অনেকে গানের মূল বিষয়টা ঠিক না রেখে অনেক টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে। আমি মনে করি এতে কোনো সুফল বয়ে আনে না। গানটা কোনো দিন জোর করে শোনানো যায় না। আমার যদি কোনো গান ভালো না লাগে, কেউ কি পারবে আমাকে তা জোর করে শোনাতে। গানটা হচ্ছে মনের বিষয়। মন থেকে যদি কোনো গান ভালো না লাগে, আমি কী করে গানটি শুনব। আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে চলতে হবে, তার মানে এই নয় যে, যা খুশি তাই করতে হবে। ইউটিউব এখন একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে যা খুশি তা প্রকাশ না করাই ভালো।

 

কুমার বিশ্বজিৎ

আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে চলতে হবে। আর বর্তমানে মিউজিক ভিডিও প্রচারণায় ইউটিউব একটি শক্ত মাধ্যম। আমি বলতে চাই আমাদের মাধ্যমটা ঠিক আছে, কিন্তু মূল বিষয়টা ঠিক নেই। আর মূল বিষয়টা হচ্ছে গান। ভালো গান না করে অনেক টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে কী হবে। এখন আমাদের বুঝতে হবে কারা অনলাইনে গান শুনে। এই ইউটিউব ব্যবহারকারী কারা। আমরা জানি একটি নির্দিষ্ট বয়সের দর্শক-শ্রোতা ইউটিউব ব্যবহার করে। এই নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা দিয়ে কেউ কোনো দিন জনপ্রিয় হতে পারে না। আমার নব্বই শতাংশ গানের এখনো কোনো মিউজিক ভিডিও হয়নি। তাই বলে আমার গান কি জনপ্রিয় নয়?

 

ফাহমিদা নবী

প্রতিটি মানুষের ভিতরে একটি সুপ্ত বাসনা আছে। তার মধ্যে অনেকগুলো ভালো আর কিছু মন্দ। আমরা এখন যা মন চায় তাই করি। এই আধুনিকতার যুগে গান প্রচারের একটি শক্ত মাধ্যম হচ্ছে ইউটিউব। এখানে অনেকে যা মন চাচ্ছে তাই দিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক নয়। একটা সময় আমরা রেকর্ডে গান শোনতাম। তারপর এলো ক্যাসেট, এমনি করে সিডি, ডিভিডির পালা শেষ হয়ে এখন গান চলে আসছে অনলাইনে। সময়ের সঙ্গে চলতে হলে আমাদের আধুনিক হতে হবে। তার মানে এই নয় যে, গান নিয়ে যা খুশি তাই করব। আমি মনে করি গানের প্রয়োজনে মিউজিক ভিডিও হয়। কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টো। একটি ভালো গানের জনপ্রিয়তার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।

 

ইমন সাহা

একটা সময় কিছু সিনেমা নির্মাতা ও প্রডিউসার শুধু নির্মাণের জন্য সিনেমা বানাত। তাদের সিনেমা শুধু সংখ্যায় বাড়ত। কিন্তু যখন মুক্তি পেত তখন তারা দর্শক পেত না। তারা নিজের টাকা দিয়ে টিকিট কিনে হলের বাইরে ঝুলিয়ে দিত হাউস ফুলের ব্যানার। এটি ছিল তাদের মনের সান্ত্বনা। এ বিষয়টি বলার একটি কারণ আছে। কিছুদিন আগে আমেরিকার একটি রেডিওতে আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ফোন করে। আমার জনপ্রিয় গানগুলো সম্পর্কে জানতে চায়। তখন আমি দেখলাম, আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘খায়রুন সুন্দরী’র ইউটিউবে লাইক আছে মাত্র ৮ লাখ। কিন্তু সম্প্রতি কিছু নতুন মিউজিক ভিডিওর লাইক দেখলাম ২০ লাখেরও বেশি। অথচ গানটি আমার আশপাশের কেউই শুনেনি। তাহলে কী করে এত লাইক হলো। এ গল্প বলার কারণ হচ্ছে, বুস্ট করে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় না। এত টাকা খরচ করে বুস্ট না করে, ওই টাকা দিয়ে ভালো কিছু গান করা দরকার।

 

পার্থ বড়ুয়া

আগে পাড়ায়-মহল্লায় সিডি দোকানে বড় বড় স্পিকারে গান বাজত। এখন সেই চল উঠে গেছে। সবাই এখন মোবাইলে, হেডফোনে গান শোনেন। ফলে গান এখন কানে কানে হিট হয়, জনে জনে পৌঁছায় না। হিট করানোর জন্য নতুন নতুন পথ খুঁজছে সবাই। তাই এখন শুধু একটি অ্যালবামের কয়েকটি গানই নয়, রীতিমতো পুরো একটা মিউজিক ভিডিও অ্যালবাম প্রকাশের দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। বিষয়টি আমাদের সংগীত জগতের জন্য সুফলদায়ক নয়। মূলত অ্যালবাম প্রমোশনের জন্যই একটা-দুইটা গানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করা হয়। প্রমোশনের টার্গেট থাকায় বড় বাজেটে তৈরি হয় মিউজিক ভিডিও। তাই মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে বাজারজাত করার দরকার পড়ে না। প্রায় সবকটি চ্যানেলে সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠান আছে। প্রমোশনের জন্য তাই সেগুলোকেই কাজে লাগানো হয়ে থাকে। আবার টিভিতে প্রচারের পাশাপাশি ইউটিউবেও প্রকাশ করা হয়। সেখানে বুস্ট করে ভিউয়ার বাড়িয়ে আয় করে নিচ্ছেন।

 

বাপ্পা মজুমদার

ইউটিউবে গানের ভিউ দিয়ে হয়তো জনপ্রিয়তা মূল্যায়ন করা যায়, কিন্তু সেই ভিউ কতখানি জাস্টিফাইড, সেটার সত্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। নিঃসন্দেহে কোনো গানের ১০ কোটি, ৫ কোটি কিংবা এক কোটি ভিউ— এত মানুষ একটি গান শোনে বা দেখে এটা বিশাল ব্যাপার। বর্তমান বাজারে এক কোটি মানুষ একটি গান শুনছে বা দেখছে, এটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু সে অনুযায়ী ফিডব্যাক পাচ্ছি কি? যে গানটি এক কোটি বা দশ কোটি ভিউ হয়েছে, সেই গান তো সবার মুখে মুখে থাকার কথা। ভিউ দিয়ে বিচারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আগামী প্রজন্মের সংগীত। গান তৈরির আগেই তাদের মাথায় একটি বিষয় ঢুকবে, ভিউ কত হবে। এই বিষয়টি কষ্টকর।

সর্বশেষ খবর