শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

থেমে গেল রুপালি গিটার

আলী আফতাব

থেমে গেল রুপালি গিটার

এই রুপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে...। হ্যাঁ, লাখ-কোটি ভক্ত শ্রোতাকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা ব্যান্ডের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ও গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। সুরের জাদুতে হাজারো মানুষকে আত্মীয়তার বাঁধনে বেঁধেছিলেন এই মানুষটি। বাংলা ব্যান্ডের একটি স্বর্ণালি অধ্যায়ের নাম আইয়ুব বাচ্চু। তিনি ছিলেন এলআরবির ২৭ বছরের কাণ্ডারি। বাংলা ব্যান্ড যদি জাহাজ হয় তাহলে সেই ব্যান্ডের ক্যাপ্টেন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। গিটারে তিনি সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত। জিমি হেন্ড্রিক্স এবং জো স্যাট্রিয়ানির বাজনায় তিনি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত। আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লেব্যাক শিল্পী। এলআরবি ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং ভোকাল বাচ্চু বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন। এর আগে তিনি দশ বছর সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত গুণী এই শিল্পী তার শ্রোতা-ভক্তদের কাছে এবি (অই) নামেও পরিচিত। তার ডাক নাম রবিন। মূলত রক ঘরানার কণ্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, ক্লাসিক্যাল সংগীত এবং লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

বাচ্চুর সংগীত জগতে যাত্রা শুরু হয় ফিলিংস ব্যান্ডের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে। তার কণ্ঠ দেওয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। গানটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত রক্তগোলাপ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ এর মাধ্যমে।

১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম এলআরবি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম সুখ ও তবুও বের হয়। একই বছর তার চতুর্থ  অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক বাংলা ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তার গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। ২০০৯ সালে তার একক অ্যালবাম বলিনি কখনো প্রকাশিত। ২০১১ সালে এলআরবি ব্যান্ড থেকে বের করেন ব্যান্ড অ্যালবাম যুদ্ধ। ৬ বছর পর তার পরবর্তী একক অ্যালবাম জীবনের গল্প বাজারে আসে। এই অ্যালবামে ১০টি গান রয়েছে। গানের কথা লিখেছেন সাজ্জাদ হোসাইন এবং সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন আইয়ুব বাচ্চু নিজে।

আইয়ুব বাচ্চুর নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম এবি কিচেন। তিনি ২০১০ সালে ঈদের জন্য নির্মিত ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি শিরোনামের নাটকে অভিনয় করেন।

 

কিংবদন্তি সংগীতকার আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডের হয়ে গান করেন। সেই পথচলায় তার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী নকিব খান, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, পার্থ বড়ুয়ার মতো মিউজিশিয়ান। আইয়ুব বাচ্চুর চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তাদের কিছু কথা—

নকিব খান

আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আমরা সোলসে একসঙ্গে  অনেক বছর গান করেছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এখনই তার চলে যাওয়ার সময় হয়নি। যদিও গত কয়েক বছর ধরে তার শরীরের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। তারপরও গান-পাগল এই মানুষটা গানের জন্য ছুটে বেড়িয়েছে সারা দেশ।

 

 

তপন চৌধুরী

আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আইয়ুব বাচ্চুর মতো এত বড় মিউজিশিয়ান আর আসবে না। অনেক বড় মাপের শিল্পী ছিল বাচ্চু। সোলসে আমি তার সঙ্গে দশ বছর কাজ করেছি। গান ও মিউজিক নিয়ে তার জ্ঞান ছিল অনেক। বাচ্চুর সঙ্গে শেষ দেখা হয় আমার সংগীত জীবনের ৮০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে। অনেক আড্ডা ও কথা হয় সেই দিন তার সঙ্গে।

 

কুমার বিশ্বজিৎ

সোলসে আমি আর আইয়ুব বাচ্চু অনেকটা সময় একসঙ্গে গান করেছি। তার মতো এত বড় মিউজিশিয়ান আর আসবে না। আমাদের তরুণ ব্যান্ড শিল্পীদের নিয়ে সে অনেক কাজ করেছে। ও এলআরবির ২৭ বছরের কাণ্ডারি হয়ে কাজ করেছে। একটি ব্যান্ড কী করে ধরে রাখতে হয় তা তার জানা ছিল।

 

 

পার্থ বডুয়া    

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির একজন লিজেন্ড। তার গান ও মিউজিক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আমাদের গানের ভুবনে আইয়ুব বাচ্চু যেসব গান দিয়ে গেছেন তা সারাজীবন শ্রোতারা মনে রাখবে। আরও অনেকটা সময় চেয়েছিলাম তাকে আমাদের পাশে, এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির পাশে।

 

 

বিপ্লব

বর্তমানে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রিয় সহযোদ্ধার মৃত্যু সংবাদ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। বিপ্লব বলেন, ‘মেনে নিতে পারছি না বাচ্চু ভাই নেই, মানুষ চলে যাবে, কিন্তু এভাবে অসময়ে কেন রাজা চলে গেলেন, রাজার মতো করে।’

 

 

অ্যালবাম ও জনপ্রিয় গান

  একক অ্যালবাম

রক্তগোলাপ (১৯৮৬)

ময়না (১৯৮৮)

কষ্ট (১৯৯৫)

সময় (১৯৯৮)

একা (১৯৯৯)

প্রেম তুমি কী (২০০২)

দুটি মন (২০০২)

কাফেলা (২০০২)

রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮)

বলিনি কখনো (২০০৯)

জীবনের গল্প (২০১৫)

 

ব্যান্ড অ্যালবাম

এলআরবি (১৯৯২)

সুখ (১৯৯৩)

তবুও (১৯৯৪)

ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫)

ফেরারি মন (১৯৯৬)

স্বপ্ন (১৯৯৬)

যুদ্ধ (২০১১)

স্পর্শ (২০১৩)

 

জনপ্রিয় গান

‘চলো বদলে যাই’,

‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’, ‘সুখ’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’ ইত্যাদি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর