শুক্রবার, ২ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজবাড়ী জেলার সংস্কৃতির সাতকাহন

পান্থ আফজাল

রাজবাড়ী জেলার সংস্কৃতির সাতকাহন

এক সময় পালাগান, যাত্রা, নাটকে রাজবাড়ী জেলার বিশেষ ঐতিহ্য ছিল। একদা জেলার গ্রামাঞ্চলে চাঁদ সওদাগর, বেহুলা লখীন্দরের কাহিনী অবলম্বনে স্থানীয় ভাষায় ভাসানযাত্রা বিশেষ পরিচিত হতো। সে সময় রাজবাড়ীতে নাট্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল হোসনেবাগ হল। কিন্তু প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সদিচ্ছার অভাবে এটি আজ ভাগাড়ে পরিণত। ১৯৪০ সালের দিকে বাণীবহের জমিদার কালীপ্রসন্ন মজুমদার বর্তমান চিত্রা সিনেমার স্থানটি দান করেন এবং সেখানে গড়ে ওঠে রাজবাড়ী টাউন হল। পরবর্তীতে ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলের অনুদানে হলটি পরিচালিত হতো। চিত্রা হল নামে পরিচিত এ হলে তৎকালীন সময়ে সপ্তাহে তিন দিন নাটক প্রদর্শনী হতো। ব্যক্তিগত মালিকানা হলেও এটি এখন ভোগ করছে প্রশাসন। ডিসি এর সভাপতি। আর রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের সঙ্গে এটি হচ্ছে হাতবদল। এই হলের সুবিধা রাজবাড়ীর সংগঠনগুলো জানে না বা ভোগ করতে পারে না বলে মন্তব্য রাজবাড়ীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের। এ দিকে জেলার সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম মাধ্যম শিল্পকলা গঠিত হয়েছিল জেলার সব সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একত্রিত করে শিল্পচর্চা এবং সংস্কৃতি লালন-পালনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। আগে কয়েকবার নির্বাচিতদের দিয়ে শিল্পকলার কার্যক্রম চললেও এখন প্রশাসনের পছন্দের লোকদের ইচ্ছামাফিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে যেন চলছে শিল্পকলা। পরিচালনা পর্ষদে অসীম পালসহ কতিপয় ব্যক্তি চেয়ার দখল করে রেখে জেলার শিল্পচর্চায় তেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন না বলে সংগঠনগুলোর অভিযোগ। এর আগে শিল্পকলা সংস্কারে বাজেট বরাদ্দ হলেও এখনো বেশি হল ভাড়া দিয়ে ভাঙা চেয়ার, ভাঙাচোরা দুর্বল চিনচিনে সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শিল্পকলার টয়লেটেও যেতে হয় নাক বন্ধ করে। হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে চরম অসন্তোষ গান, আবৃত্তি, নৃত্য কিংবা তবলা শিখতে আসা শিশুর অভিভাবকদের। এদিকে শিল্পকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাজবাড়ী সদরের শ্রীপুরে দেশের বৃহৎ সাংস্কৃতিক চর্চা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হলেও সেটি আজ রাজনৈতিক দলাদলিতে বন্ধ। তৈরির প্রথম দু-একবার বড় করে বিভিন্ন জেলার সংস্কৃতিবান মানুষকে নিয়ে সম্মেলন হলেও এটি এখন অ্যাক্রোবেটিক সেন্টার হিসেবেই চলছে। জেলার বিভিন্ন মানুষের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও কেন একটি অডিটোরিয়াম তৈরি হয়নি? সবার সদিচ্ছা থাকলে টাউন হলের পাশেই কিন্তু অডিটোরিয়াম হতে পারত। রাজবাড়ী জেলার বিশিষ্ট সংগঠক ও সমাজসেবক অ্যাডভোকেট দেবাহুতি চক্রবর্তী বলেন, ‘সংগঠনগুলোর সেই জৌলুস আর নেই, করুণ অবস্থা বলা চলে। নতুন কর্মী-সংগঠক নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে কারও সময় নেই ভালোবেসে কোনো সংগঠন করার।

অভিভাবকদেরও এখন আর আগ্রহ নেই তার বাচ্চাদের দিয়ে বাড়তি সাংস্কৃতিক চর্চার। এখন তো সবাই রাজনৈতিক চর্চায় বেশি ব্যস্ত। শিশুদের মনন বিকাশের নিমিত্তে যেসব শিশু সংগঠন ছিল, এখন কর্মী সংকটে সেসবও স্থবির।’ তবে রাজবাড়ী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেই জৌলুস না থাকলেও এখনো রাজবাড়ীতে সংগঠনের কমতি নেই। রাজবাড়ীর সাংস্কৃতিক চর্চায় অগ্রদূত আবোল-তাবোল শিশু সংগঠন। আর রাজবাড়ীতে শিশুদের আবৃত্তি প্রসারে আট বছর আগে প্রতিষ্ঠিত প্রিয়তমেষু আবৃত্তি নিকেতন সংস্কৃতি প্রসারে রাখছে অনন্য ভূমিকা। এ ছাড়াও রাজবাড়ী আবৃত্তি পরিষদ, রবীন্দ্র সম্মিলন পরিষদ, দোলনচাঁপা সংগীতাঙ্গন, স্বদেশ নাট্যাঙ্গন, মঙ্গলনাট, একজ, বুনন আর্ট স্পেস, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, আমরা ক’জনা, বৈচিত্র্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক সময় এ জেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল চারণ থিয়েটার। তবে সাংস্কৃতিক বিকাশে উপযুক্ত প্রশাসনিক কোনো উদ্যোগ না নিলে জেলার সংস্কৃতি ও সংগঠন হুমকির মধ্যে পড়বে বলে জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ আশঙ্কা করছেন।

সর্বশেষ খবর