সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা সিনেমা হল বন্ধ নিয়ে

উৎকণ্ঠা সিনেমা হল বন্ধ নিয়ে
অশনি সংকেতের কবলে পড়েছে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। গত আর চলতি মাসে পর পর দুটি বড় সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। গত মাসে বন্ধ হয়েছে রাজশাহীর উপহার আর চলতি মাসের গত শুক্রবার বন্ধ হলো গাজীপুরের ‘চান্দনা’। গাজীপুরে ছিল ১৪টি সিনেমা হল এর মধ্যে ১১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৫ জেলা এখন সিনেমা হলশূন্য। কুমিল্লার ‘পালকি’ সিনেমা হলটিও সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোর নেতারা শিল্পটিকে নিয়ে কি ভাবছেন। তাদের কথা তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আবু মুসা দেবু [সভাপতি, এডিটরস গিল্ড]

আগে প্রযোজক একটি ছবি নির্মাণ করে পরিবেশকের কাছে যেতেন। উভয়ে মিলে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। বর্তমানে এই দুই সংগঠনের মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বুকিং এজেন্টের উদ্ভব হয়েছে। তারা ছবির রেন্টাল নির্ধারণ করেন কমিশনের ভিত্তিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রযোজক ও প্রদর্শক। এ ছাড়া নতুন প্রযোজক যারা আসছেন তাদের অনেকে বিনোদনমূলক ছবি নির্মাণ করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, সিনেমা হল ডিজিটাল হওয়ায় একটি টিকিট থেকে প্রযোজক পাচ্ছেন মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ার মানি। বাকিটা নানা অজুহাতে সিনেমা হল মালিকরা নিয়ে নিচ্ছেন। সরকার যদি স্বল্প সুদে সিনেমা হল সংস্কার, নির্মাণ আর ডিজিটালাইজ করে দেয় তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পের সুদিন ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার [সভাপতি, পরিচালক সমিতি]

অধিকাংশ সিনেমা হলের পরিবেশ ঠিক নেই। ডিজিটাল প্রদর্শনের নামে প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে চলছে প্রতারণা। সিনেমা হল কমে যাওয়ায় লোকসানের দিকে ফিরে যাচ্ছেন প্রযোজকরা। সিনিয়র প্রযোজক-পরিচালকরা এখন আর নির্মাণে নেই। প্রযোজকের অভাবে নতুন পরিচালকরা বেকার। এই দৈন্যদশার কবল থেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে উদ্ধার করতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সিনেমা হল আধুনিকীকরণ, প্রতি জেলায় সিনেপ্লেক্স নির্মাণ, সিনেমা হলে ডিজিটাল প্রজেক্টর স্থাপন। সরকারি অনুদানের অর্থ বৃদ্ধি করে বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণে অনুদান প্রদান, অনুদানের ছবি সঠিকভাবে নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করা ইত্যাদি পারলে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে।

 

খোরশেদ আলম খসরু [সাবেক কর্মকর্তা, প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি]

প্রযোজক যদি মূলধনই ফেরত না পান তা হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন কেন। আগে হিট আর ফ্লপ বলে দুটি শব্দ ছিল। এখন বছরে একটি কি দুটি ছাড়া বাকি ছবি চলেই না। নকলের নৈরাজ্য আর পুরনো ফর্মুলা থেকে এখনকার নির্মাতারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না। সিনেমা হলে ভালো পরিবেশ নেই। ডিজিটালের নামে চলছে প্রতারণা। সরকার, চলচ্চিত্রের ও সাধারণ মানুষ মিলে টার্গেট করতে হবে ২০ টাকা হারে প্রতি টিকিটে ১ কোটি মানুষ ছবি দেখবে। না হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় কেউ আর বিনিয়োগ করবেন না। আর এই খাতে যদি লগ্নিকারক পাওয়া না যায় তা হলে ছবিও নির্মাণ হবে না, সিনেমা হলও থাকবে না। বাংলাদেশ হয়ে পড়বে একটি দেশের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম সিনেমা হলশূন্য।

 

 

মিশা সওদাগর [সভাপতি, শিল্পী সমিতি]

পর্যাপ্ত ছবির অভাবে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে।  সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মুনাফা দূরে থাক লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায় প্রযোজকরা নির্মাণ থেকে দূরে সরছেন। অনেক প্রযোজক আবার যৌথ আয়োজনের নিয়ম-নীতি না মেনে এই ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেক সিনেমা হল মালিক ব্যবসা করছেন ঠিকই কিন্তু সিনেমা হল সংস্কার বা নিজে প্রজেক্টর স্থাপন করছেন না। পরিবেশ ভালো না হওয়ায় অনেক সিনেমা হলে দর্শক আর যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এই শিল্পটির অস্তিত্ব এখন ধ্বংসের মুখে। চলচ্চিত্রাঙ্গনের সবাই মিলে এসব সমস্যা নিয়ে যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবে শিল্পটি আবার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

 

 

ইফতেখার নওশাদ [সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]

পর্যাপ্ত ও মানসম্মত কনটেন্ট না পেলে সিনেমা হল মালিকরা আর কত লোকসান গুনবে। মাসের শেষে বিদ্যুৎ ও পানির বিল, স্টাফদের বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে। ছবির অভাবে ব্যবসা নেই। এ অবস্থায় এসব খরচ কোথা থেকে বহন করবেন সিনেমা হল মালিকরা। স্থানীয় ছবির অভাবে বিদেশি ছবি এনে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। তাও নানা বাধার মুখে স্থবির হয়ে পড়েছে। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছে। ছবি আমদানি-রপ্তানিও নানা জটিলতায় বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এতে এই লোকসানি ব্যবসা বন্ধ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। দেশীয় নির্মাতারা যদি পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি দিতে পারেন আর না হলে বিদেশি ছবি একই সঙ্গে উভয় দেশে মুক্তির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে হয়তো সিনেমা হল বন্ধ রোধ করা যাবে।

সর্বশেষ খবর