বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ

আমার কুৎসিত রূপ দেখে পাকবাহিনী কাছে এলো না

আমার কুৎসিত রূপ দেখে পাকবাহিনী কাছে এলো না
প্রখ্যাত অভিনেত্রী কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। তার আরেকটি পরিচয় তিনি খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের স্ত্রী। দুজনই অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। এই অভিনেত্রী বললেন মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে তার সব প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির কথা। তার সেসব স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছিল?

প্রত্যাশাতা একটিই ছিল, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীন করব। স্বাধীনতার জন্য লড়েছি। লাখো প্রাণের বিনিময় আর নানা আত্মত্যাগে আল্লাহর রহমতে একটি স্বাধীন ভূখন্ড, নিজস্ব পতাকা আর বাঙালি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করেছি। স্বপ্নের সোনার বাংলা পেয়েছি। এই প্রাপ্তি মানে প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ হওয়া।

 

অপ্রাপ্তি বোধ আছে?

না, অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই। দুঃখ হয় যারা দেশের জন্য লড়াই করে শহীদ হয়েছেন আর অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো স্বীকৃতি পাননি, নানা দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করছে তাদের জন্য। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার। মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো কষ্টে আছেন তাদের কষ্টমোচন করার উদ্যোগ নেবেন এই সরকার এটিই আমার প্রত্যাশা।

 

ব্যক্তিগত কোনো দুঃখবোধ?

তাতো সবারই কম বেশি আছে। যুদ্ধের সময় আমার মায়ের পরিবারের ৯ সদস্য মানে পুরো একটি পরিবারকে পাক বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ তারা বাঙালি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এতটাই নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করা হয় যে প্রথমে প্রত্যেককে দিয়ে নিজের কবর খুঁড়িয়ে নেয় পাক হানাদাররা। এরপর তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আমার স্বামী জহির রায়হান এবং ভাসুর শহীদুল্লাহ কায়সারকে হারিয়েছি। তারপরেও বলব, অর্জনে ত্যাগ থাকবেই। এই ভেবে খুশি যে, এত ত্যাগের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জন করতে পেরেছি।

 

স্মৃতির কথা শুনতে চাই-

সেইদিনের কথা মনে পড়লে ভয়ে এখনো শিউরে উঠি। জহির রায়হান অনেক আগেই কলকাতা গিয়ে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে শুরু করলেন। তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি সেখানে তিন মাস প্রদর্শন করে যে অর্থ পেলেন তা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দিলেন। পত্র-পত্রিকায় লিখে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গড়ে তুললেন। আমি আমার ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে ১৫ দিনের মাথায় অনেক কষ্টে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছলাম। একটি স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িতে উঠলাম। মুক্তিযোদ্ধারা জহির রায়হানের কাছে আসতেন। তাদের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। তাদের পরনের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতাম। রেধে খাওয়াতাম। নিজেরা দিনের পর দিন উপস করতাম। তারপরেও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকতাম স্বপ্নের সেই স্বাধীনতার।

 

যে স্মৃতি মনকে আজও নাড়া দেয়-

হ্যাঁ, এমন অনেক স্মৃতিই আছে, একটির কথা বলি, অভিনয় করতে গিয়ে অনেক রকম মেকআপ নিতে হতো। অভিনেত্রী হিসেবে পাকিস্তানিরাও আমাকে চিনে। তাই তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য মাথায় চিপচিপে তেল দিয়ে সিঁথি কেটে চুলকে চ্যাপ্টা করেছি। মুখসহ সারা শরীরে কালি মেখে বিশ্রী চেহারা বানিয়েছিলাম। কলকাতা যাওয়ার পথে যখন কুমিল্লা পৌঁছলাম তখন পাক আর্মিরা আমাকে ঘিরে ফেলল। যখন ঘোমটা সরালাম তখন আমার বদসুরুত দেখে তারা আর কাছে এলো না। আমি কথা না বলে ইশারায় তাদের বোঝালাম বাচ্চারা অসুস্থ। আমাকে যেতে দেওয়া  হোক। তারা আমার কুৎসিত রূপ দেখে আমাকে ছেড়ে দিল। কথাটা মনে পড়লে আজও ভাবি অভিনয় করতে গিয়ে অনেক মেকআপ নিতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের এই মেকআপ অন্য সব মেকআপকে উতরে দিয়েছে।

 

স্বাধীনতার অনুভূতি কেমন ছিল?

সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এত রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা শুনে অব্যক্ত আনন্দে চোখের জল অঝোরে গড়িয়ে পড়ল। সেই আনন্দ শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়। অন্য কোনোভাবে নয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবনার কথা?

এই গর্বের কোনো শেষ নেই। শুধু দেশে নয়, বিদেশে গেলেও সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাকে সম্মান জানায়। আমার কাছ থেকে স্বাধীনতার গল্প শুনতে চায়। ভালো লাগে যখন দেখি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ কীভাবে এখন বিশ্ব দরবারে সমৃদ্ধির ইতিহাস নিয়ে দ্রুত মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। সত্যি, এই খুশি যুদ্ধে আমার সব হারানোর বেদনা দূর করে দেয়। মনে পড়ে যায় মান্না দের সেই গানের কথা-‘যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি আমার মন’।

সর্বশেষ খবর