বুধবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘুমিয়ে গেলেন সুরের পাখি বুলবুল

আলী আফতাব

ঘুমিয়ে গেলেন সুরের পাখি বুলবুল

জন্ম : ১ জানুয়ারি, ১৯৫৬, মৃত্যু : ২২ জানুয়ারি, ২০১৯

‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মতো দেশাত্মবোধক গানের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল গতকাল চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ঘরে বসে আমৃত্যু করেছেন গানের সাধনা। নিজের মতো থাকতে ভালোবাসতেন নীরবে-নিভৃতে। ঝাঁকড়া চুল আর হাসিমাখা কথার মধ্যে লেগে ছিল শান্তির প্রলেপ। অকালে ছোট ভাই হারানোর শোক, দুষ্কৃতকারীদের হামলার হুমকি, নানা অসুখের কারণে অনেকদিন ধরে শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন না তিনি। এ কারণেও তার শরীর খারাপ হয়েছিল শেষদিকে। অবশেষে সব দুশ্চিন্তা-ঝামেলা কাটিয়ে চিরশান্তির নিদ্রায় গেলেন বুলবুল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভোররাত থেকেই শুরু হয় বুলবুলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ। গানের, সিনেমার, নাটকসহ সংস্কৃতির মানুষ গুণী এই মানুষটিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। অনেকেই ছবি পোস্ট করছেন, লিখছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ। ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। দেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া বহু দেশাত্মবোধক গানে। ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন বুলবুল। এরপর আমৃত্যু তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সংগীতের সাধনায়। বেলাল আহমেদের পরিচালনায় ১৯৮৪ সালে নয়নের আলো চলচ্চিত্রের সংগীতায়োজন করেন বুলবুল। ওই সিনেমার জন্য তার লেখা ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে’ গানগুলো সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর পরের চল্লিশ বছরে মরণের পরে, আম্মাজান, প্রেমের তাজমহল, অন্ধ প্রেম, রাঙ্গা বউ, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, পড়ে না চোখের পলক, তোমাকে চাই, লাভ স্টোরি, ভুলো না আমায়, আজ গায়ে হলুদ, লাভ ইন থাইল্যান্ড, আন্দোলন, মন মানে না, জীবন ধারা, সাথী তুমি কার, হুলিয়া, অবুঝ দুটি মন, লক্ষ্মীর সংসার, মাতৃভূমি, মাটির ঠিকানাসহ দুই শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন বুলবুল। প্রেমের তাজমহল সিনেমার জন্য তিনি ২০০১ সালে এবং হাজার বছর ধরে সিনেমার জন্য ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। দেশের সংগীত অঙ্গনে অবদানের জন্য ২০১০ সালে সরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে একুশে পদকে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত আয়োজনের পাশাপাশি দেশের সমকালীন শিল্পীদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছেন বুলবুল। তার কথা আর সুরের গান নিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ দেশের বহু জনপ্রিয় শিল্পীর অ্যালবাম বের হয়েছে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারই প্রেমও ভিখারি’, ‘ও আমার মন কান্দে’, ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা’, ‘আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ ইত্যাদি। 

 

---------------------  গাজী মাজহারুল আনোয়ার

বুলবুলের মৃত্যু হতে পারে না! বুলবুল আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। সে দেশের অন্যতম একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সে পুরষ্কারপ্রাপ্ত, হয়েছে সম্মানিত। এখন দুঃসময় এসেছে, তাই সে চলে গেছে। হাজার বছর কেউ বাঁচে না; চলে যেতে হয় সবাইকেই। কিছু কিছু লোক আছে যারা কখনোই চলে যায় না। বুলবুল তাদের মধ্যে একজন। সে প্রচুর কাজ করেছে। সে মাটি ও মানুষের কথা বলেছে, যেটা গানের কথা ফুটে উঠেছে। শুধু দেশের গান নয়, চলচ্চিত্রের গানে তার ছিল ব্যতিক্রমী প্রয়াস। সাময়িকভাবে এ জগৎ থেকে সে অব্যাহতি নিয়েছে। মানষের অন্তরে সে বেঁচে থাকবে আজীবন।

 

------------------- সাবিনা ইয়াসমিন

 

খুব কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে, আমরা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। বুলবুল এদেশের একজন প্রতিথযশা সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এমন একজন সংগীত পরিচালকের সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। এটাই আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। বুলবুলের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ বিটিভির জন্য একটি অনুষ্ঠানে। বুলবুল চলে গেল, যেন আমাদের সবই শেষ হয়ে গেল।

  

 

----------------- শহীদুল্লাহ ফরায়জী

তিনি বাংলা গানকে দিয়েছেন এক উচ্চতম মাত্রা। দিয়েছেন গভীর ব্যঞ্জনা। তিনি দেশাত্মবোধক গানের আইকন। বাংলা গানে রয়েছে অজস্র অবদান। তিনি বাংলা গানকে করেছেন সমৃদ্ধ ও গতিশীল। গানকে দিয়েছেন পরিপূর্ণতা। তিনি ছিলেন সংগীতাঙ্গনের অপরিহার্য অংশ। যত দিন বাংলা গান রয়েছে, তত দিন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বেঁচে থাকবেন।

 

 

 

--------------------   কুমার বিশ্বজিৎ

আমি তো তার পরিবারেরই একজন। শ্রোতা হিসেবে বলব, তার মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা সর্বদা মনে করি, শিল্পীদের জন্মই হয়েছে শুধু বিনোদন দেওয়ার জন্য। শিল্পীরাও মানুষ। রয়েছে স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার। তাদের যে তৃষ্ণা, ক্ষুধা, পরিবার, জীবন, মন, উপলব্ধি রয়েছে তা ভুলে যাই। গত বছর থেকে এ বছরে সংগীত জগতের অনেকে ট্যালেন্ট পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বেঁচে থাকতে আমরা তাদের মূল্যায়ন করি না। মৃত্যুর পর এক্কেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তিনি ছিলেন একজন ফ্যান্টাস্টিক গিটারিস্ট। আমার সঙ্গেও তিনি বাজিয়েছেন। তিনি ছিলেন দেশের মহামূল্যবান সম্পদ, সংগীতাঙ্গনের মহান সৈনিক। প্রজন্ম প্রজন্ম তাকে নিয়ে একসময় গর্ব করবে। এমন ক্ষণজন্মা মানুষ আর আসবে কিনা সন্দেহ! শিল্প যে একটা শৈল্পিক তার সৃষ্টিতে তা বোঝা যায়।

 

------------------------ কবীর বকুল

কি আর বলব! এই আকস্মিক মৃত্যু কাম্য ছিল না। দেশের সংগীতাঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তার শূন্যতা কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়। আমরা একজন অভিভাবক হারালাম। দেশের সংগীত জগতে তার ছিল বিশাল অবদান। তিনি এমন একজন গীতিকার ও সুরকার যিনি দীর্ঘ আট বছর শুধু দেশের গান করেছেন।  চলচ্চিত্রেও তার ছিল অমূল্য অবদান। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছিলেন একাধারে একজন প্রখ্যাত গীতিকার-সুরকার। তার সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যিখানে, আম্মাজান, অনন্ত প্রেম বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে।

 

-------------------       এন্ড্রু কিশোর

আমার সৌভাগ্য যে, বুলবুল ভাইকে শেষ দেখাটা দেখতে পেরেছি। কারণ আমার তো আজ সকালেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। এটা সত্যি যে, বুলবুল ভাই চলে গেলেন এটা আমি ভাবতেই পারছি না। কারণ তার সঙ্গে আমি এত কাজ করেছি, এত সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে, আমি ভাবতেই পারছি না যে, তিনি নেই। যতদূর মনে পড়ে বুলবুল ভাইয়ের সুর সংগীতে আমি প্রথম একটি ফোক সিনেমায় গান গেয়েছিলাম। তবে তার সুর সংগীতে আমার প্রথম হিট গান ছিল মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘আঁখি মিলন’ সিনেমার আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে গানটি।

 

 

শোকার্ত তারকারা

 

সর্বশেষ খবর