ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে নতুন বাংলাদেশ। নতুনভাবে দেশ গড়ার প্রত্যয় সবার। জনসাধারণের মতো বৈষম্যহীন দেশের প্রত্যাশা শোবিজ অঙ্গনের তারকাদেরও। জেনে নেওয়া যাক কেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তারকাশিল্পীদের। কয়েকজন শিল্পীর প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও পান্থ আফজাল
এ দাবি ৭১ সালেও হয়েছিল : সোহেল রানা
ছাত্ররা এবার যেটা দাবি করেছে এটা দ্বিতীয়বারের মতো দাবি। একই দাবি আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় করেছিলাম। ওই সময়ের দাবির মধ্যেই ছিল বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি, প্রত্যেকের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা, ধর্ম পালনে স্বাধীনতা, ভোটের অধিকার ইত্যাদি। আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব দাবি মলিন হয়ে গিয়েছিল। তাই বর্তমানে ছাত্র-জনতার এ দাবিকে আমি বলি আমাদের সেই দাবির পুনঃজাগরণ।
১৯৭১ সালের ছাত্র-জনতার দাবিগুলো সব সরকারের আমলেই তারা অন্যায়, অত্যাচারের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ম্লান করে দিয়েছে। দেশের প্রতিটি সেক্টরে যে পরিবর্তন আনার কথা ছিল তা হয়নি। ২০২৪ সালে এসেও ব্রিটিশ আইনকানুন দিয়ে এ দেশ চলছে। পুলিশ কারও পেটুয়া বাহিনী নয়, তারা জনগণের বন্ধু। তারাও চলছে ব্রিটিশ আইন দ্বারা। বিচার বিভাগে এখনো ব্রিটিশ শব্দ ‘মি লর্ড’ ব্যবহার করা হয়। তাহলে আমরা কেন স্বাধীনতা যুদ্ধ করলাম। ১৯৭১ সালে যে পরিবর্তনের জন্য ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত দিয়েছিল সেই পরিবর্তন না হওয়ায় আবারও এবার ছাত্র-জনতা প্রাণ আর রক্ত দিল। আমরা যেন এবার আর ভুলে না যাই যে ছাত্রদের ত্যাগ কখনো বৃথা যায় না। পৃথিবীতে কখনো ছাত্র আন্দোলন দমানো যায় না। সেনাবাহিনী এবার চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, কারফিউর মধ্যেও তারা গুলি ছুড়েনি।
আমি তাই সেনাবাহিনীকে স্যালুট জানাই। পুলিশ বাহিনীও চেইন অব কমান্ড মেনে কাজ করেছে। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ বিশৃঙ্খলা ছড়িয়েছে। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সন্ত্রাসী ও লুটেরাদের শাস্তি নিশ্চিত করা ও পুলিশের লুট হওয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা। দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। জাতির মধ্যে যেন আর কোনো বিভেদ না থাকে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেমন ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তেমনি বিভেদ ভুলে আমরা যেন সত্যিকারের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং অন্যায়কারীদের শাস্তি নিশ্চিত হয় সেটাই এখন আমার প্রত্যাশা।
বৈষম্যহীন দেশ চাই : ববিতা
একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এদেশের ছাত্র-জনতা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই চাওয়া কি এ জাতির এখনো পূরণ হয়েছে? না, হয়নি। আর তাই বারবার বঞ্চিত হতে হতে সবার পিঠ যেন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ কারণেই ছাত্র-জনতা বৈষম্যহীন সোনার বাংলার গড়ার দাবিতে আবার রাজপথে নেমে এসেছে। বুকের তাজ রক্ত দিয়ে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছে। আমি চাই এ রক্ত যেন আর বৃথা না যায়। সব দাবি বাস্তবায়ন ও স্বৈরশাসনমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমি চাই।
৭১-এর চাওয়া বাকি রয়েছে : কাজী হায়াৎ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন কাজী হায়াতের যে চাওয়া ছিল তা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, ভাতের ও ভোটের অধিকার নিশ্চিতকরণ, বাসস্থান এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকার। এসব চাওয়া এখনো আমার রয়ে গেছে। সব মানুষ যেন সমঅধিকার পায়, মানুষ যেন তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, এবং সমাজে অন্যায়ের সঠিক বিচার হয়, আমি এখনো তা প্রত্যাশা করি। রাষ্ট্র পরিচালনায় একনায়কত্ব চাই না। সর্বস্তরের মানুষ যেন সমঅধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারে আমি সেই প্রত্যাশাই করছি।
জবাবদিহির স্বচ্ছতা চাই : তারিক আনাম
প্রত্যাশা সব সময়ই থাকে, এবারও আছে। রাজনৈতিকভাবে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে তা সমঝোতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিলে ভালো হয়, নইলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। এমন বিভাজন
কাম্য নয়। সরকার বা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সবার জবাবদিহির স্বচ্ছতা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাক স্বাধীনতার অধিকার থাকতে হবে, সত্য কথা বলতে যেন কেউ ভয় না পায়। উন্নয়ন যেভাবে আছে সেভাবে চলতে থাকুক, তবে চাইব সেটা আরও সুনিয়ন্ত্রিত হোক। সংস্কৃতিতে আরও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ বড় পরিবর্তন এসেছে। আশা করি, এটার ভালো প্রতিফলন ঘটবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর সুফল পাবে।
মানবিক সমাজ চাই : ফারুকী
এখন আমাদের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন-এগুলোকে সংস্কারের ব্যবস্থা করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাওয়া। এ সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা। আইনের শাসনকে শক্ত করে তুলতে হবে, যাতে কেউ এ সফল আন্দোলনের অপব্যবহার না করতে পারে। বাংলাদেশে মন্দির থাকবে, মসজিদ থাকবে, প্যাগোডা থাকবে, গির্জা থাকবে, বোরকা থাকবে, জিনস থাকবে-সবকিছুই থাকবে বহুজনের এ সমাজে। আশার কথা, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে আমি এ বিষয়ে সচেতনতা দেখতে পাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমরা একটা মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের দিকে এগিয়ে যাব।
দুর্নীতি চলবে না : আসিফ আকবর
শেষ পর্যন্ত আমাদের ছাত্রসমাজ বিজয়ী হয়েছে। প্রমাণিত হয়ে গেল বাংলাদেশে ১৯৫২, ৬৯, ৯০ এবং ২০২৪-ছাত্ররা কখনো ব্যর্থ হয়নি। এখন নতুন বাংলাদেশ হবে। আগের মতো লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি হবে না, এটাই প্রত্যাশা। প্রতিটি দল থেকে গণতন্ত্র চর্চা শুরু করতে হবে। এ আন্দোলন রাজনীতিবিদদের জন্য অ্যালার্ট। ভবিষ্যতে ভুল করলে এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে। স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি আর চলবে না। নতুন প্রজন্ম জেগে উঠেছে। তারা আর সহিংসতাভিত্তিক দলের সঙ্গে থাকবে না। প্রতিহিংসা ভুলে সবাই আমরা নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলব। ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, এটা ছাত্ররাই ঠিক করবে।
মানবিক গণতান্ত্রিক দেশ চাই : প্রিন্স মাহমুদ
এ বিজয় ছাত্রদের, এ বিজয় জনতার বিজয়। মনে রাখা উচিত সহিংসতার রাজনীতি আর নয়, একেবারেই নয়। এ প্রজন্ম লড়াই করেছে ন্যায্য অধিকার আর বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। এটা আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। হানাহানি আর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। তাজা প্রাণের এ বলিদানকে মনে রাখতে হবে। এ বলিদান যেন ব্যর্থ না হয়। সংযম চাই, শৃঙ্খলা চাই, মানবিক গণতান্ত্রিক একটা দেশ চাই। দলীয়করণের পরিণাম আমরা দেখেছি। চাটুকারিতার পরিণাম আমরা দেখেছি। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পরিণাম আমরা দেখেছি। এ থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নেওয়া উচিত। কিছুদিন পরেই যেন আমরা এসব ভুলে না যাই। পুরনো কিছুর মতো নয়, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ চাই।
সমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে : সাবিলা
দ্রুত আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সব ধর্মের, সব বিশ্বাসের মানুষ যেন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে, তার জন্য সমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। সবাই যেন নিজেদের কথা স্পষ্টভাবে বলতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষায় যা যা করা প্রয়োজন সেগুলো যেন করা হয়। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি প্রয়োজন। আমাদের দেশের অন্যতম বড় চিন্তার বিষয় দুর্নীতি। আমি চাইব অন্তর্র্বর্তীকালীন এ সরকার প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি রোধে কাজ করবে। এখন থেকে কাউকে যেন কোনো কাজে ঘুষ দিতে না হয়। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক চেয়ে আন্দোলন করেছিল ছাত্ররা। নতুন সরকার নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করুক।
গণতন্ত্র রিস্টার্টের শুরু : অমিতাভ রেজা
এটা নতুন প্রজন্মের জয়। ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সংহতি জানিয়ে বলেছিলাম, ওরাই রাষ্ট্র ঠিক করবে। ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, এটা ছাত্ররাই ঠিক করবে। সুতরাং নতুন সরকারে তাদের অংশগ্রহণ যেন থাকে। সংবিধানে যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন, সেখানেও যেন তারা অংশগ্রহণ করে। গণতন্ত্র রিস্টার্টের এটা মাত্র শুরু। আমাদের টিচার্স নেটওয়ার্ক থেকে যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে সেটা যেন পালন করা হয়। বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হলো।