বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক হচ্ছে যাত্রাপালা। বিশেষ করে গ্রামীণ বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে যাত্রাপালাকেই গণ্য করা হতো। অথচ কয়েক দশক ধরে যাত্রাপালায় চলছে চরম খরা। নানা কারণে হারাতে বসেছে সরল বিনোদনের এই আবশ্যক শিল্পটি। চলতি বছরও এই খরার চিত্র থেকে রেহাই পাচ্ছে না যাত্রাশিল্প। দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন থেকে শুরু হয়ে পরের বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত থাকে যাত্রা মৌসুম। সেই হিসেবে আগামী ১০ অক্টোবর থেকে এই মৌসুম শুরু হচ্ছে, কিন্তু চলতি বছরও যাত্রাপালার খরা কাটেনি- এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন যাত্রা সংশ্লিষ্টরা। যাত্রা নিয়ে তাদের কথাই তুলে ধরা হলো এখানে-
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি এম এ মজিদ বলেন, বাংলাদেশে যাত্রাশিল্প এক সময় খুবই গতিশীল ছিল। তবে আশির দশকে এসে এতে নাচের প্রবণতা বেড়ে গেল এবং একটা সময় এসে এই নৃত্য অশালীনতার পর্যায়ে পৌঁছাল। আমরা মনে করেছিলাম এই অশ্লীলতার কারণে যাত্রা দেখতে দর্শক কমে গেছে ও প্রশাসন অনুমতি দিচ্ছে না। কিন্তু এরপর একটি ঘটনা ঘটতে দেখে আমাদের বোধ হলো, যাত্রাপালার খরার জন্য শুধু অশ্লীলতাকে দায়ী করা যায় না। কারণ হঠাৎ করে ২০০১ সালে বেশকটি যাত্রা মঞ্চে বোমা হামলা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গের নেপমরদ মেলায় এ হামলা চালানো হয়। একসময় খোদ রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগে একটি যাত্রা প্যান্ডেলে দুজন নৃত্যশিল্পীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়। এতে যাত্রা মঞ্চায়ন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। এ মুহূর্তে আসন্ন দুর্গাপূজায় যাত্রা মৌসুমে দেশে যে কোথাও যাত্রা মঞ্চস্থ হবে এমন কোনো খবর আমাদের জানা নেই। আমি নিজেই গত রবিবার সিলেটের যেখানে চা বাগানগুলোতে তিন দিনব্যাপী যাত্রা মঞ্চস্থ হয় সেখানে যোগাযোগ করে জানতে পারি, সেখানেও এবার যাত্রাপালা হবে না। এদিকে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের সঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ এবং যাত্রাদল মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি বৈঠকে বসে। সে সময় শিল্পকলার মহাপরিচালক যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের যাত্রা পরিষদ এক সময় দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে এখন সুখের কথা হচ্ছে, সম্প্রতি ওই বিভক্ত দুটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছে। এতে সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন বেলায়েত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক হলেন সোহেল হায়দার জসিম। আমি সহসভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। এখন আমরা পূজা পর্যন্ত দেখব যাত্রাপালা কোথায় কী অবস্থায় আছে এবং মঞ্চায়ন হচ্ছে কি না। পূজার পরেই একটি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেব দলগুলোকে কীভাবে গতিশীল করা যায়। এ ছাড়াও সারা দেশে মেলা পার্বণ এবং যাত্রা আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাত্রা আয়োজনের সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে নবগঠিত যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ। বর্তমানে দুই শতাধিক যাত্রাদল সরকারিভাবে নিবন্ধিত রয়েছে। যাত্রাশিল্প ধ্বংসের প্রচেষ্টায় কারা লিপ্ত আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে এম এ মজিদ বলেন, কিছু কট্টর ইসলামপন্থি দল যাত্রাপালা ধ্বংসের অপতৎরতায় লিপ্ত। কারণ তারা সব সময়ই নাচ, গান, নাটক, যাত্রা সিনেমার বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা মিলন কান্তি দে বলেন, এবার দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সব সেক্টরই স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। যাত্রাপালাতেও তাই। দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে যাত্রা মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু যাত্রা প্রদর্শক বা নায়েক পার্টিরা বলছেন, এ ট্র্যাডিশনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। ডিসি অনুমতি দিলেই এবার যাত্রা মঞ্চায়ন করা হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, প্রতি বছর যাত্রা হোক বা না হোক দেশের পঞ্চগড় জেলায় ৮/১০টি থানায় যাত্রা অনুষ্ঠান হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারও সেখানে যাত্রা মঞ্চায়নে পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে। রিহার্সেলে অংশ নিচ্ছে বিভিন্ন জেলার যাত্রা শিল্পীরা। সেখানে পূজার ষষ্ঠীর দিন থেকে যাত্রা চলবে। এ দুর্গাপূজাতে শুরু হয়ে তা লক্ষ্মী ও কালীপূজা পর্যন্ত মাসখানেক ধরে যাত্রার কনসার্ট চলবে। যাত্রাশিল্পের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ মুহূর্তে আশাব্যঞ্জক খবর হলো, দেশে যাতে যাত্রা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে মঞ্চায়ন হয় সেজন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসকদের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন। এ জন্য যাত্রাপালা মালিক, শিল্পী ও আমি মহাপরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এ ছাড়া আমরা যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। ৬ অক্টোবর আইন বিচার ও সংসদ উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে আমাদের বৈঠকের কথা রয়েছে। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের পর আলোচনার ফলাফল অনুযায়ী আমরা যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করব। যাত্রাপালা ধ্বংসের চেষ্টা কারা করছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মিলন কান্তি দে বলেন, সংস্কৃতিবিরোধী একশ্রেণির অপশক্তি যাত্রাশিল্পকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে যাত্রা মঞ্চে ১৯৮১-৮২ সাল থেকে অশ্লীলতার আয়োজন করে। মূলত এ অপশক্তিই যাত্রাশিল্প ধ্বংসের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।