২১ মার্চ, ২০১৮ ০৮:০৭

উপেক্ষিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র

উপেক্ষিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র

স্বাধীনতার পর ঢালিউডে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতাদের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়। এ ধরনের ছবি জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হতে থাকে। এই ধারাবাহিকতা আশির দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও এরপর এতে ভাটা পড়ে। ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ। বিষয়টি তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুনিরা মোরশেদ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘শিশুদের চলচ্চিত্র এখন আমাদের দেশে উপেক্ষিত। নির্মাতা থেকে শুরু করে সমাজের সবাই মনে করেন, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। আমাদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী অনুদানের চলচ্চিত্রে একটা করে শিশু চলচ্চিত্র বানানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। অথচ পরে এ বিষয়টি আর জোর পায়নি।’

মুনিরা মোরশেদের আক্ষেপের সুর ধরেই বলা যায় সত্যিই এখন ঢাকাই ছবিতে শিশুতোষ চলচ্চিত্র উপেক্ষিত। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে যখন এফডিসি বিল পেশ করা হয় তখন সংসদ সদস্য ইমদাদ আলী বিল পেশকারী বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী [চলচ্চিত্র বিষয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত] শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক শিশুদের মন ও চরিত্র গঠন উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এর এক বছর পর তৎকালীন প্রাদেশিক সচিব কফিলউদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পাকিস্তান শিশু চলচ্চিত্র সমিতি। বিদেশি দূতাবাসের সহায়তায় ঢাকার নাজ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হয়  শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন মাসিক ‘সিনেমা’র সম্পাদক ফজলুল হক। তার স্ত্রী লেখিকা রাবেয়া খাতুনের কাহিনী নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘সান অব পাকিস্তান’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দফতরের প্রযোজনায় চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ও পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের নির্দেশনায় সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী নির্মাণ করেন ‘অংকুর’ চলচ্চিত্রটি। পরে তিনি শিশু একাডেমির প্রযোজনায় নির্মাণ করেন আরেকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘গল্প দাদুর গল্প কথা’। এরপর ১৯৮০ সালে আরেক চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী বাদল রহমান সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। ছবিটি সেরা ছবি হিসেবে ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এরপর খান আতাউর রহমানও শিশু একাডেমির প্রযোজনায় নির্মাণ করেন ‘ডানপিটে ছেলে’। এই ছবিটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। স্বাধীনতার পর সরকারি পর্যায়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে তাতে সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি অনুদানে নির্মিত তিনটি ছবির মধ্যে অবশ্যই একটি শিশুতোষ হতে হবে। আদৌ তা হয়নি। সত্তর দশকের শেষের দিকে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর  লেখা গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’ অবলম্বনে সুভাষ দত্ত তৈরি করেছিলেন ‘ডুমুরের ফুল’ শিশুতোষ চলচ্চিত্রটি। এরপর আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, সিবি জামানের ‘পুরস্কার’ শিশুতোষ ছবিগুলোও জাতীয় পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা এবং সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা কুড়ায়। সত্তর ও আশির দশকে সংখ্যায় কম হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য  দেশগুলোর সঙ্গে মানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে শিশুতোষ ছবি নির্মাণ শুরু হয়েছিল। পরিতাপের বিষয়, নব্বই দশক থেকে যখন ভারতের চলচ্চিত্রের মান ক্রমে বেড়ে হলিউডের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে আমাদের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ থমকে গেছে। কালেভদ্রে এ জাতীয় ছবি এখন নির্মাণ হলেও তার পরিমাণ হতাশাজনক। ২০০৯ সালে  তৈরি করা হয় দেশের প্রথম শিশুতোষ ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস দূরবীনের আলোকে নির্মিত এই ছবিটির জন্য পরিচালক জাফর ফিরোজ মুম্বাই ফিল্ম একাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরিতে সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশি নির্মাতাদের মধ্যে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে সবচেয়ে সফলতা দেখিয়েছেন   মোরশেদুল ইসলাম। তার নির্মিত ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬), ‘দূরত্ব’ (২০০৪) ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১) শিশু-কিশোরদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। দুঃখের বিষয় হলো ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ এ যাবৎ পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য মিলিয়ে মাত্র বিশটির মতো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে।

তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে এবং বিশ্বায়নে পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় চলে আসায় স্বভাবতই উন্নত বিশ্বের তৈরি হাইটেক শিশুতোষ মুভি শিশুদের এবং অভিভাবকদের এখন অতিমাত্রায় আকর্ষণ করছে। ২০০০ সালে ‘মন্টু মিয়া অভিযান’ নামে এনিমেশন একটি মুভি তৈরি করা হয়। প্রচার হয় একুশে টিভিতে। এর তিনটি পর্ব নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশে শিশুতোষ আর  কোনো সম্পূর্ণ এনিমেশন মুভি নির্মাণের তথ্য  নেই। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই ছবিতে শিশুতোষ চলচ্চিত্র রয়ে গেছে উপেক্ষিত। যা সত্যিই হতাশাজনক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর