২১ এপ্রিল, ২০১৮ ১০:২০

আসুন আলতাবানুর পাশে দাঁড়াই

দীপংকর দীপন

আসুন আলতাবানুর পাশে দাঁড়াই

দীপংকর দীপন

১. আমার বিশ্বাস ছিল অরুন দা ভাল করবেন, কিন্তু এতটা ভাল করবেন আর এতটা আধুনিক সিনেমা বানাবেন, আমি সত্যিই আশা করিনি। কারণ আমি জানতাম কতটা কম বাজেট- কতটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাকে কাজটা করতে হয়েছে। স্যালুট অরুন দা।

২. শহরের সাথে খুব পাল্লা দিয়ে বদলাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামগুলো। পাল্টাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, হচ্ছে নতুন ও পুরনো বিশ্বাসগুলোর মিশ্রণ। তাই আজকের সিনেমায় বদলে যেতেই হবে চরিত্র, চরিত্রের ঘটনা এবং পরিণতিগুলো। সেই পরিবর্তনের হাওয়াটা অনুভব করা যায় জালালের গল্পে, মাটির প্রজার দেশে আর আলতাবানুতে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের নতুন গল্প।

৩. আলতাবানু আমার কাছে আজকের দিনের শেষের কবিতা। শেষের কবিতার মূল উপজীব্য ছিল যুগসন্ধিক্ষণ, সেটার একটা ২০১৮ সালের রূপ আছে আলতাবানুতে। কুসংস্কার, সাইবার ক্রাইম, নারীবাদ, ওমেন ট্রাফিকিং, ছাত্রনেতা, ভাল-খারাপ দু'ধরণের পুলিশিং, গার্মেন্টস, সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্ট অন ওয়ারকিং এরিয়া, ভায়োলেন্ট দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ- তাও আবার ভিকটিম নারীর, দুটো ভিন্ন চেহারার দুটি আধুনিক নারী, জঙ্গিবাদের ইঙ্গিত, প্রতারণা, অব্যক্ত প্রেম- সমসাময়িক অনেক কিছু এসেছে আলতাবানুতে- কিন্তু সবচেয়ে অভাবনীয় বিষয় হচ্ছে এত সব কিছুতে ফোকাস সরেনি- বড়বোনের ছোট বোনকে খুঁজে বেড়ানোর জার্নিটার পরতে পরতে মিশে গেছে কনটেমপরারি কনন্টেন্টগুলো।

৪. দর্শককে ধরে রাখার ক্ষমতা। আমার দুপুর একটায় একটা জরুরি কাজ ছিল, যেখানে ছবি শেষ হতে হতে পৌনে দুইটা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ঘণ্টা খানের আগে বেরিয়ে যাব, পারিনি, অরুনদা বসিয়ে রেখেছেন, কাজের বারোটা বাজিয়েছেন- তাতেও অনাবিল সুখ একটা দেশি চলচ্চিত্রই তো আটকে রেখেছে। বাংলাদেশের এক একটা ভাল সিনেমা আমার বুকের ছাতি আরেক ধাপ বড় করে দেয়।

৫. অভিনয়। মমর অভিনয়ের ক্ষমতার সাথে আমি পরিচিত। ছুয়ে দিল মনে- তার ছিটে ফোটাই পেয়েছি। এখানে অনেকটা। স্যালুট করার মত পারফরমেন্স, গর্ব করার মত শিল্পী।মিলন ভাই- আহা। বিদেশের ওমেন ট্রাফিকিং এর সাথে যুক্ত ভালমানুষের মুখোশ পরে থাকা নায়ক-চরিত্রের পরিণতিতে হয়ে উঠে প্রেমিক-ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে মার খেয়ে ভুত হয়ে যায়- কিন্তু ভেতরের মানুষটা জেগে উঠে। কী সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে চরিত্রটি। আহা মিলন ভাই- অনেকদিন পর তোমাকে পেলাম। রিক্তা, রমিজ রাজু, অন্তু, সাবেরী আপা, দিলারা মা- কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি। ভাল অভিনয়ের মেলা বসেছে আলতাবানুতে। যারা বলে আমাদের ভাল অভিনয় শিল্পী- তাদের বলি আসেন আলতা বানু দেখেন- স্বপ্নজাল দেখেন - আয়নাবাজি দেখেন, নিজের দেশের প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে শেখেন। তবে এর পেছনে একজন অরুন চৌধুরী, একজন গিয়াস উদ্দীন সেলিম লাগে, একজন অমিতাভ রেজা চৌধুরী লাগে- তাও আমাদের আছে। আছে আরো অনেক নাম। অনেক মেধাবী নির্মাতা।

৬. নো স্পুন ফিডিং। আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি আলতাবানু ছবির এই বৈশিষ্ঠটাতে। আলতা বানুর গল্পটা বুঝতে হলে আপনাকে মাথা খাটাতে, অরুনদা আপনাকে চামচে করে খাইয়ে দেবেন না। মূল গল্পের অনুসঙ্গ বুঝতে হলে, দেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক উপাদানগুলোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আপনাকে কিছু লিঙ্ক মিলিয়ে নিতে হবে, যে লিঙ্কগুলো ছবির পরতে পরতে অরুনদা দিয়ে গেছেন। আমি তাই আলতাবানুকে স্মার্ট সিনেমার কাতারে রাখবো। আমার মতে স্মার্ট সিনেমার মূল গুণ এটাই।

৭. আলতাবানু ছবির শেষে গিয়ে আর দুটি বোনের গল্পে হয়ে থাকে না- মানবতার গল্প হয়ে উঠে। স্পয়লারের কারণে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। আর সেখানেই আলতাবানু একটি মহৎ সিনেমা হয়ে উঠে। আহা।

৮. বন্ধুরা আমাকে বলে আমি নাকি কোন সিনেমাকে ভাল বলতে শুরু করলে অনেক বেশি ভাল বলে ফেলি, ভুল ক্রটিগুলো আমার চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে, কিন্তু সেগুলো আমার কাছে বড় হয়ে উঠে না। কারণ আমিতো জানি সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়? অন্যকে টেনে নামানোর দৌঁড়ে আমি নেই। সম্ভাবনা দেখলে চাতকের মত তাকিয়ে থাকি। একটা ভাল সিনেমার আশায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাময় দিকগুলো তুলে ধরতে ধরতে আমরা একদিন সারা বিশ্বের কাছে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রের দেশ হয়ে উঠবো।

আপনার পছন্দ নাও হতে পারে এরকম কিছু কিছু বিষয় আছে আলতাবানুতে- তবে পজেটিভ মন দিয়ে দেখলে সেগুলো আপনি ইগনোর করতে পারবেন অনেক অনেক ভাল বিষয়ের ভিড়ে। ইনফ্যাক্ট সেগুলো নিয়ে কথা বলার সময়ই পাবেন না। তবে একটা বিষয়- অরুনদা চাইলে পারতেন- গানে একটু জোর দিতে। তাহলে আমরা পুরনো কিছু গানের নতুন রূপ না পেয়ে নতুন কিছু গান পেতাম, সেটা বেশি আবেদনও রাখতো হয়তো। সম্পাদনা খুব ভাল, ব্যাক গ্রাউন্ড স্কোর ঠিক মানিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় আলতা চরিত্রের অস্থিরতা- খানিকটা সিনেমাটাকে সংক্রমণ করেছে আর তাতেই জাস্টিফিকেশন হয়েছে অস্থিরতাটা, তবে দু'একবার থিতু হয়ে বসলে কাঁদলে- কাঁদালে খারাপ লাগতো না হয়তো।

৯. আমাদের কাজটা কী এবার? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটা। আলতাবানুর প্রচার এত কম কেন, এত কম হল কেন? এরকম ভাল অনেক ছবি এক সপ্তাহ পরে হল থেকে নেমে গেছে- আসুন না আলতাবানুর পাশে দাঁড়াই। অরুন দা নিভৃতচারী মানুষ- তার পাশে গিয়ে না দাঁড়ালে তিনি হয়তো একলাই যতটা পারবেন লড়ে যাবেন। আলতাবানুর কথা ছড়িয়ে দেই- আলতাবানু হলে গিয়ে দেখি- অন্যকে দেখতে বলি। আমার এই লেখাটি শেয়ার করি, সাংবাদিকরা এই লেখাটি ছাপেন, দেখেন, লেখেন। ঢাকা অ্যাটাক যাদের ভাল লেগেছিল তাদের কাছে খানিক দাবি নিয়েই অনুরোধ করছি- আলতাবানু দেখেন, দেখান, দেখতে বলেন। আলতাবানুর পাশে দাঁড়ান- একবারে খাঁটি একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পাশে দাঁড়ান- বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান। দেশটা আমাদের- চলচ্চিত্র আমাদের- ভালবাসা আমাদের। তাই পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আর আলতাবানু সেটা ভালমতই ডিসার্ভ করে।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/২১ এপ্রিল, ২০১৮/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর