৮ এপ্রিল, ২০১৭ ১৪:৩৩

শুধু এইটুকু জেনো, তুমি যে ছিলে হৃদয়ের প্রতিবেশী

রিমি রুম্মান, যুক্তরাষ্ট্র

শুধু এইটুকু জেনো, তুমি যে ছিলে হৃদয়ের প্রতিবেশী

গতকাল ছিল ৭ই এপ্রিল ২০১৭ইং, শুক্রবার। আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। ১৯৯৫ সালের ৭ই এপ্রিল, দিনটিও ছিল শুক্রবার। মাঝে কেটে গেছে সুদীর্ঘ ২২টি বছর।

সেই ইডেনে পড়ার সময় কামাল ডিভি লটারি (ডাইভারসিটি ভিসা প্রোগ্রাম) আবেদন করেছিলো বন্ধুদের অনেকের নামেই। আমাকেও একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, ভেতরের তথ্যগুলো সঠিক কিনা দেখে মেইল করে দিও। রুমে এসে সেটি তোষকের নিচে রেখে দেই। একসময় ভুলেও যাই।

এক বিকেলে নীলক্ষেতে কিছু নোট ফটোকপি করে ফিরবার পথে অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকদিন পর আবারও কামালের সাথে দেখা! খামটি ডাকবাক্সে ফেলেছি কিনা জানতে চাইলো। বললাম, নামের বানান ভুল আছে, তাই মেইল করিনি। 'রুম্মান' এর অংশটুকুতে 'রহমান' লেখা। সে বলল, 'আজই তো আবেদন করার শেষদিন। আমাকে দাও, আমি সংশোধন করে মেইল করে দিবো । 

দু'জন হাঁটতে হাঁটতে হোস্টেলের সামনে এলাম। বললাম, আপনি অপেক্ষা করুন, আমি নিয়ে আসি। তোষকের নিচে অবহেলায় পড়ে থাকা খামটি এনে ফিরিয়ে দেই তাকে।

মাসখানেক বাদে ডাইনিং এ রাতের খাবারের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়েছি সবে। রুমমেট আপু এসে জানালেন, তোমার ভিজিটর এসেছে। রাতে কোন ভিজিটর দেখা করার অনুমতি পায় না, জানি। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে ডেকে দেয়া হয়। কে এলো, কোন দুঃসংবাদ কিনা ... এসব ভেবে হাত পা অবশ হয়ে আসছিলো।

দোয়া পড়তে পড়তে গেটের সামনে গিয়ে দেখি কামাল দাঁড়িয়ে। বলল, 'তুমি কি জানো, তুমি ডিভি লটারি জিতেছ?' সত্যতা জানার জন্যে হোস্টেলের কয়েনবক্স থেকে আপার ধানমণ্ডির বাসায় ফোন করে একই খবর পাই। বাবার বাসার ঠিকানায় আবেদনের প্রতিউত্তর এসেছে, সত্যিই আমি ডিভি লটারি জিতেছি। রুমে এসে চুপচাপ বসে থাকি। কারও সাথে বিষয়টি শেয়ার না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। বন্ধু শাহিনার রুমে যাই। সে ততোক্ষণে শুয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে খুব কাছে গিয়ে মশারির এপাশ থেকে নিচু স্বরে বলি, 'শাহিনা, জানিস, আমি নাকি ডিভি পেয়েছি'।

শাহিনা লাফিয়ে উঠে। হৈচৈ ফেলে দেয়। বীথিকেও একই কায়দায় খবরটি দেই। সে চোখ গোলাকৃতি করে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে, 'কস্‌ কি!' অসময়ে হোস্টেলে ঘণ্টা বাজতে থাকে। তখন তো খাবারের সময় না, তবে ঘণ্টা কেন! সব রুম থেকে সকলেই দরজার ওপাশ থেকে মাথা বের করে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে। বীথি ঘণ্টা বাঁজাতে বাঁজাতে উচ্চস্বরে বলে চলছে, রিমি ডিভি পাইসে... রিমি ডিভি পাইসেএএএএ......।

এরপরের দৃশ্যপট খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। আব্বা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর নিয়ে আসে। চেনা জানা মুরুব্বী'রা, যারা এতদিন তাদের পুত্রদের জন্যে ধনী পিতার কন্যা খুঁজছিলেন পুত্রবধূ হিসেবে, তারা আমার মধ্যবিত্ত বাবার কন্যাকে পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চাইছেন! আমার সহজ সরল বাবা ভুল করেননি। সঠিক মানুষটিই বেছে নিলেন। দু'পরিবার বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। 

পরের সপ্তাহে আমরা দু'জন অশ্রুজলে আমাদের স্বজন, চেনা গণ্ডি সব ছেড়ে আকাশযানে চেপে বসলাম অচেনা এক দেশের উদ্দেশ্যে, নতুন এক জীবনের আশায়। সৃষ্টিকর্তা যার জন্যে যাকে সৃষ্টি করেছেন, তার সাথে কোন না কোনোভাবে মিলন হবেই, আমার বিশ্বাস। নইলে আমাদের অপ্রত্যাশিতভাবে কেনই বা নীলক্ষেতে দেখা হয়ে গেলো!

অতঃপর কেটে গেলো ২২টি বছর। হাঁটছি একসাথে বুড়ো হবার পথের দিকে। যে পথে একজন থুড়থুড়ে বুড়িকে ডায়াবেটিস আয়ত্তে রাখতে বুড়ামিয়া হাত ধরে রোজ ভোরে হাঁটতে বের হবে। কিংবা সর্বাঙ্গে ব্যথায় কাতরাতে থাকা একজন বুড়ামিয়াকে থুড়থুড়ে বুড়ি টাইগার বাম মালিশ করে দিতে দিতে কবিতা শুনাবে-
হিসেব করো না কতোটুকু দিলে,
কতো কম, কতো বেশি
শুধু এইটুকু জেনো, 
তুমি যে ছিলে হৃদয়ের প্রতিবেশী ...... :

সকলে ভালো থাকুন।
আমাদের প্রার্থনায় রাখুন।


(লেখকের ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)


বিডি প্রতিদিন/৮ এপ্রিল, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর