৮ মে, ২০১৭ ১০:০১

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি

রিমি রুম্মান, যুক্তরাষ্ট্র

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি

প্রতীকী ছবি

মা'কে নিয়ে আমার লেখাগুলো পড়ছিলাম একের পর এক। যে লেখাটি পড়ে মন একটু বেশিই ভারি হয়ে থাকলো দিনভর......

মা যখন আকুতি করলেন, 'তোর আব্বা মারা গেছে প্রায় দু'বছর হয়, একবার দেশে আয়, ঘুরে যা'... আমি গেলাম না। ক'মাস বাদে হুট করেই দেশে গিয়ে হাজির। মা'য়ের আকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদে এ যাওয়া। দাদার বাড়িতে দোয়া পড়ানো হচ্ছে, গরীবদের খাওয়ানো হচ্ছে। উঠোনে বিশাল শামিয়ানা টানানো হলো। ভোর থেকেই বাড়িময় কোলাহল, লোকে লোকারণ্য। দূর দূরান্ত থেকে আমার ফুফু, ফুফাতো ভাই বোনেরা এলো। অন্য স্বজনরা এলো। থম্‌থমে পরিবেশ।

ফুফু আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, 'তোর মা কত যত্ন করে তোদের বড় করল, ক্যামনে এই আদরের সন্তানগুলিরে রাইখা একলা চইলা গেল।' কেউ কেউ বললো, 'মন খারাপ কইরো না, তোমার মা আল্লাহ্‌র নেক বান্দা ছিল। রোগে ভুগে নাই, রোগশয্যায় কাউরে কষ্ট দেয় নাই। আল্লাহ্‌র কাছে শুক্‌রিয়া জানাও!' আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি। সান্ত্বনার বাণী শুনি। স্বজনদের বিচিত্র এই সহানুভূতির কোন উত্তর খুঁজে পাই না। বাড়ির পিছনের বাগানে গিয়ে একলা বসে থাকি। সারি সারি নারিকেল, সুপারির গাছ। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বয়। মনে পড়ে, জায়গাটা পরিত্যক্ত পুকুর ছিল। বাবা শখ করে মাটি ফেলে ভরাট করে এই গাছগুলো লাগিয়েছিল নিজ হাতে। গাছগুলো বড় হলো, মন জুড়ানো বাগান হলো। প্রতি শুক্রবারে ভোরের ট্রেনে গ্রামে এসে সারাদিন কাটাতো বাবা। ঠিক এইখানে এমন করে বসে থাকতো, উত্তরের শীতল বাতাসে।

এখান থেকে একতলা বাড়িটি অস্পষ্ট দেখা যায়, যেখানে একদল স্বজন আমার মা কেমন ভাল মানুষ ছিলেন, কবে কাকে কেমন করে সাহায্য করেছিলেন, সেইসব আলোচনায় মগ্ন। মৃত্যুর পর একজন মানুষকে নিয়ে কতো আয়োজন! অথচ জীবিত থাকার সময়টাতে আমরা তাকে নিয়ে এমন করে ভাবিনা, এমন করে ভালবাসি না। এখন আর মৃত মানুষটিকে নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই, অযাচিত আশা নেই, চাওয়া নেই। আছে কেবলই ভালোবাসা!

দিনভর দোয়া পড়ানো হলো, গরীব খাওয়ানো চললো। সন্ধ্যায় আমরা তিনটি এতিম ভাইবোন বাবা-মা'র কবরের পাশে ক্ষণিক নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলাম। অতঃপর শহরে ফিরে এলাম। বাবার বাড়ি। অনেক কষ্টে শিষ্টে বানানো চারতলা বাড়িটি যেন অশ্রুসজল হয়ে বিষণ্ণ, এক্‌লা দাঁড়িয়ে। আমার জন্ম, বেড়ে উঠা স্মৃতিময় বাড়ি। আলমিরায় মায়ের শাড়িগুলো ভাঁজে ভাঁজে সাজানো। মা যেমন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন, ঠিক তেমনই আছে তখনো। সেখানে মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ, আমার চিরচেনা সেই মিষ্টি গন্ধ! মায়ের আকুতি কানে বেজে উঠলো- 'একবার আয়, এসে ঘুরে যা, মন হালকা হবে।' সে-ই তো এলাম! মন হালকা হয়নি, ভারি হয়ে আছে। খু-উ-ব ভারী। এতো ভারি যে, শ্বাস নিতে পারি না!

মায়ের আকুতি শুনিনি, এই অতৃপ্তি সমস্ত দিন আমায় কাঁদালো। রাতেও ঘুম এলো না। বাতাসে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো আর বিদ্যুতের তারের নড়াচড়া পর্দার ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ঘরের মেঝেতে আঁকিবুঁকি ছায়া ফেলে চললো রাতভর। এই ঘরে আমার মা সারারাত জেগে প্রার্থনা করতো আমাদের মঙ্গল কামনায়। এই খাট, এই চেয়ার, দক্ষিণের জানালা...। এখানে বসে ফজরের নামাজ শেষে কোরআন তেলওয়াত করতো, পৃথিবীর কোনো অশুভ, অমঙ্গলই যেন আমাদের তিন ভাইবোনকে স্পর্শ করতে না পারে। আমি অন্ধকারে সেই আশ্রয়টুকু খুঁজে ফিরি। নিভৃতে কাঁদি। প্রার্থনা করি।

উত্তাল সাগরেও একসময় ভাটার টান হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিও একসময় থামে। 
নিজেকে প্রবোধ দেই, জীবন তো মৃত্যুরই প্রতিশব্দ।
আমি ফিরে আসি বাস্তবের পৃথিবীতে। হিমেল বাতাস আর অচেনা আকাশের সামনে। জীবন চলে জীবনের নিয়মে, আর সময় এমন করেই খেলে যায় জীবন নিয়ে কাল, মহাকাল।
অন্যলোকে ভালো থাকো মা। 
দেখা হবে আবার আমাদের অদেখা এক পৃথিবীতে।

ক্ষণিকের এই জীবন নিয়ে আমাদের কতোই না অহংকার, তাই না ?

পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের জন্যে ভালোবাসা ...

 

(লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া)


বিডি প্রতিদিন/৮ মে, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর