৯ জুন, ২০১৭ ১৮:২২

নীল পাড়ের শাড়ি

ডা. মাহবুবর রহমান

নীল পাড়ের শাড়ি

আমেনা বুবুর সাথে প্রথম কবে দেখা তা আমার জানবার কথা নয়। কারণ আমার জন্মেরও কুড়ি বছর আগে থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে থাকেন। শৈশবের চোখ ফুটে যখন প্রথম আলো স্মৃতির কুঠিতে প্রবেশ করল তখন থেকেই আমেনা বুবু আমার সামনে দৃশ্যমান।

শুধু আমারই নয়, আমাদের সুবিশাল পরিবারের প্রতিটি ভাইবোনের প্রথম পদচারণা বলতে গেলে আমেনা বুবুর হাত ধরেই হয়েছে। বায়ুসমুদ্রে সর্বক্ষণ নিমজ্জিত থেকে যেমন আলাদা করে বায়ুর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি না, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি কর্মে আমেনা বুবুর অবধারিত উপস্থিতি তাকে আলাদা করে অনুভব করবার কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। 

সারাদিনের গায়ের ময়লা ধুয়ে, গা মুছিয়ে, মাথায় তেল দিয়ে, থুতনি ধরে একটা মোষের শিংয়ের কালো চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে খোকাবাবু সাজিয়ে প্লেটের খাবার খাইয়ে তার আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে পাড়ার মৌলবীর পাঠশালায় পাঠানো পর্যন্ত সর্বত্র তার স্ব-আরোপিত সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় জানা ছিল না।

আমেনা বুবুর এমন আদর কখনো কখনো নির্যাতনের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। যেমন শীতকালে প্রতিদিন পুকুরের শীতল পানিতে গোসল করা, জোর করে নারকেলের শলা দিয়ে কান পরিষ্কার করা ইত্যাদি। তবে এসব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রতিদিন রাতে খাবার পর তার কোলে মাথা রেখে আজব সব ভূতের গল্প শোনা। বিশেষ করে ব্রক্ষ্ণদৈত্যর গল্প, যার সামনে দু'চোখ আর পেছনে এক চোখ, কুচকুচে কাল মাড়ির উপর চারটে করে মূলার মতো সাদা দাঁত বসানো। সর্বনাশ তার হাত থেকে তো নিস্তার নাই! ভয়ে জড়সড় হয়ে আমেনা বুবুর আরও গা ঘেঁষে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতাম। আর আমেনা বুবু চুলে বিলি কেটে সাহস যোগাতেন। ভয় এবং সাহসের এমন বিপরীতধর্মী মিশ্রণ এক অদ্ভুত রোমাঞ্চের শিহরণ দিত।

আমেনা বুবুর রাজত্ব কেবল ছোটদের উপরই সীমাবদ্ধ ছিল না। আজ কি রান্না হবে, কে মাছের মাথাটা খাবে কিংবা কবে কোন্ পিঠা বানানো হবে তা আমেনা বুবুর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল ছিল। এত বড় সংসারের হাল মায়ের পক্ষে সামলানো অনেকটা দুঃসাধ্য ছিল বিধায় মা ও ক্ষমতার এই অংশীদারিত্ব মেনে নিয়েছিলেন।

বর্ষাকাল আর গরম খৈ গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একই ধানে নানান রকমের খৈ হতো শুধু হাতের কারুকাজে। চারিদিকে বর্ষার ঝর ঝর শব্দ অবিরাম বয়ে চলেছে, আর আমরা গরম চুলার চারদিকে মুখে হাত দিয়ে গোল হয়ে বসে আমেনা বুবুর খৈ ভাজার যাদু দেখছি। অন্যের হাতে যে খৈ কুটকুট করত, তার হাতে তা ফটফট করে হেসে উঠত। ধানের পেট থেকে খৈয়ের জন্মের এমন গগনবিদারী কান্নায় আমেনা বুবুর মুখে সৃষ্টির এক অপরূপ স্বর্গীয় আনন্দ আভা ফুটে উঠত।

এমন একটি মানুষের যে নিজের কোন চাহিদা থাকতে পারে কষ্মিনকালেও সে কথা মনে আসেনি। অতি আটপৌড়ে হালকা সবুজ জমিনে গাঢ় নীল পাড়ের একটি শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন সারা বছর। সবার খাওয়া শেষে যা কিছু বাকি থাকত তাতেই তার সব শান্তি।

স্কুলে ক্রমাগত পাশ দিয়ে দিয়ে উঁচু ক্লাসে যখন উঠলাম তখন তার জন্য মনের গহীনে কিছু একটা করবার ইচ্ছে তৈরি হল। তারমধ্যে প্রথম ইচ্ছে হল বুবুর জন্য একটা শাড়ি কেনা।

কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মেডিকেলের গন্ডি পার হয়ে ইন্টার্নশীপ শুরু করলাম। ইতিমধ্যে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ অনেক কমে গিয়ে দুই তিনমাস পরপর মাকে একটি চিঠি লেখায় ঠেকে গেছে। তখন তো আর মোবাইল ফোনের ভূবনজয়ী যুগ শুরু হয়নি। তাই মায়ের চিঠিই ছিল গ্রামের সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র।

ইন্টার্নশীপের প্রথম মাসের আড়াই হাজার টাকা হাতে পেয়ে সোজা বেইলি রোডের শাড়ি কমপ্লেক্সে গিয়ে মা আর আমেনা বুবুর জন্য দুটো শাড়ি কিনে ফেললাম। হালকা সবুজে গাঢ় নীল পাড়। আর বাবার জন্য ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি।
 
পরের দিন বাসে চড়ে সোজা বাগেরহাট। জীবনে প্রথম অর্থ উপার্জন, 'মর্ত্যে ফুটিল ফুল, হৃদয়ে হুলস্থুল' অবস্থা। স্বাধীনতার অপূর্ব স্বাদ, সকল অপূর্ণ সাধ এবার পূরণ হবার পালা।

আমাদের পাড়ার শুরুর তিন চারটি বাড়ির পরই আমেনা বুবুর বাড়ি। তাই প্রথমেই তাকে চমকে দিতে তার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। কিন্তু ঢুকতেই বুকটা ধক্ করে উঠল। বরই গাছের নীচে একটি নতুন কবর!

আমি হাঁটতে পারছিলাম না। চোখের আলো কে যেন শুষে নিচ্ছিল। বকুল আমাকে দেখে হুহু করে কেঁদে উঠল। আমার বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না।

কবরের উপর হালকা সবুজ দুর্বা ঘাসের প্রলেপ বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। যেন মাটির বাঁশি আকাশের দিকে মুখ করে জীবনের নতুন সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে।

নিজেকে অত্যন্ত নিঃস্ব এবং ব্যর্থ মনে হল। আমেনা বুবু সবুজ জমিনটুকু স্বার্থপরের মতো নিজে রেখে গাঢ় নীল পাড়টুকু চিরদিনের মতো আমার জন্য রেখে পালিয়ে গেলেন।


লেখক : কার্ডিওলজিস্ট
(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)


বিডি প্রতিদিন/৯ জুন, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর