১০ জুন, ২০১৭ ১৩:০০

মায়েদের কী অদ্ভুত ক্ষমতা, তাই না?

রিমি রুম্মান, যুক্তরাষ্ট্র

মায়েদের কী অদ্ভুত ক্ষমতা, তাই না?

ক'দিন বাদেই নিউইয়র্কের স্কুলগুলোয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হবে। স্কুলের এই শেষ সময়টাতে নানান রকম আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকতে হয় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবককে। আসছে সেপ্টেম্বরে রিয়াসাত হাইস্কুলে যাবে। 

দু'দিন আগে হয়ে গেল নতুন স্কুলটিতে প্লেসমেন্ট টেস্ট। ভোরের ট্রেনে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে। কখনো উপর দিয়ে, কখনো বা পাতাল ট্রেনে, পথিমধ্যে ট্রেন বদল করে কিভাবে যেতে হবে, তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। নির্দিষ্ট স্টেশনে নামি যখন, ততক্ষণে সকালের নরম রোদ চারিদিকে। তখনো দিন শুরুর ব্যস্ততা শুরু হয়নি। 

নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা স্টাইভেসেন্ট হাইস্কুলের সামনে পৌঁছে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, অচেনা সব মুখের ভিড়ে চেনা কাউকে খুঁজে পেলে বেশ হতো। হাসিমুখে দু'জন শ্বেতাঙ্গ বালক এগিয়ে এলো, হাত মিলালো রিয়াসাতের সাথে। ব্রায়ানকে দেখে তার মুখে স্বস্তির ছাপ। ক্ষণিক বাদেই দু'জন চায়নিজ এসে যোগ দিলো ওদের সাথে। একই স্কুল থেকে সুযোগ পাওয়া ওরা পাঁচ বন্ধু নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কে কোন বিষয় নিবে, কার প্রস্তুতি কেমন...।

ব্রায়ানের মা গভীর মমতায় ওর চুল ঠিক করে দিচ্ছিল, পানি খাইয়ে দিচ্ছিল। আমরা গল্প করছিলাম। গল্পের মাঝে বারবার ফোন বেজে উঠছিল। রিয়াসাতের বাবার ফোন। আমরা ঠিকভাবে পৌঁছেছি কি না, কখন পরীক্ষা শুরু এবং শেষ হবে ... এমনতর নানান প্রশ্ন। 

ব্রায়ানের মা বললেন, 'রিয়াসাত লাকি, কেননা তার বাবা পাশেই আছেন, খোঁজ নিচ্ছেন।' আমি বলি, 'ব্রায়ানের বাবা পাশে নেই?' বললেন, 'হুম, আছে আপস্টেটে। প্রতি উইকএন্ডে আমরা সেখানে যাই, অনেকটা সময় একসাথে থাকি। অতঃপর নিজেদের কুইন্স ভিলেজের বাড়িতে ফিরে আসি।' বললাম, 'ব্রায়ানের বাবার কর্মস্থল ওখানে?' তিরিশোর্ধ্ব লম্বা গড়নের নারী, কোন ভনিতা ছাড়াই বললেন, 'ওখানে ওঁর বাবাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।'

চোখে-মুখে বিষণ্ণতা নেই, নেই কোনো মনঃকষ্ট কিংবা বিপর্যস্ততার ছাপ। সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় বর্ণনা তার, 'আমরা প্রতি উইকএন্ডে ওর বাবার সমাধিস্থলে যাই। পাশেই মাঠ, ব্রায়ান সেখানে খেলা করে, আর আমি ঘাসের বুকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। আমি জানি, আমরা খুব কাছাকাছি আছি। শুধু একজন মাটির নিচে, আর আমরা দু'জন উপরে। আমার বিশ্বাস, সে আমাদের দেখতে পায়, খুশি হয়।'

কঠিন, অচেনা এক জীবনের গল্প শুনে আমি স্তম্ভিত। এমন অদ্ভুত সহজভাবে আবেগ অনুভূতির প্রকাশ আমি আগে দেখিনি কখনো! মৃত স্বামীর প্রতি কী গভীর ভালোবাসা! অসহায়ত্ব, শোকে মুহ্যমান সময়, নির্ঘুম রাতের পর রাত পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে সে। মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্য মেনে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কঠিন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাওয়া এক নারী। ব্রায়ান স্টাইভেসেন্ট হাই স্কুলের মতো নামী স্কুলে সুযোগ পেয়েছে ওঁর মায়ের একার যুদ্ধে।

ছেলেদের স্কুলে দিয়ে আমরা হাঁটছি। ব্রায়ানের মা বাঁয়ে ব্রডওয়ের দিকে, আর আমি চেম্বারস্ট্রিট ধরে সোজা। মনে পড়ছে মান্তাসার মায়ের মুখখানি। গত সপ্তাহেই দেখা হয়েছিলো আমাদের অনেকদিন বাদে, স্কুলের জুনিয়র আরিস্তা সেরেমনি প্রোগ্রামে। স্কুলে ৯৫ ভাগের উপরে মার্কস পাওয়া, অর্থাৎ ক্যারেক্টার, স্কলারশিপ, লিডারশীপ, সার্ভিস এই চার ক্যাটাগরিতে যারা ভালো করেছে তাদের সম্মানে আয়োজন করা অনুষ্ঠান ছিল এটি।

আমরা বাবা-মা দু'জন রিয়াসাতের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করছি হয়তো। একজন রুটি, রুজির যোগান দিচ্ছি, অন্যজন ছেলেকে নিয়ে কোচিং এ ছুটছি। কিন্তু মান্তাসা? ও যখন সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, তখনই আচ্‌মকা ওঁর বাবা মারা যায়। কোন কোচিং এ যাবার সামর্থ্য নেই। শুধু রুটি, রুজির সন্ধানেই ব্যস্ত মায়ের একার যুদ্ধে আজ সে এই অবস্থানে। ভাবা যায়! সেদিন অনুষ্ঠান শেষে স্কুল ক্যাফেটেরিয়াতে সবাই যখন কেক কাটায় ব্যস্ত, তখন সামনে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সেই মা, সেলফি তুললো। স্বাস্থ্য ভেঙ্গেছে অনেকখানি। কিন্তু আগের চেয়ে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত।
মায়েদের কী অদ্ভুত ক্ষমতা, তাই না? 

নির্ভরতার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়লেও ঘুরে দাঁড়ায় সহসাই।

তীব্র এক মানসিক শক্তি আর দৃঢ়তায় তাঁরা বেঁচে থাকে, আগলে রাখে সন্তানকে।

ভাল থাকুন সকলে...

(লেখকের পেজবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)

 

বিডি প্রতিদিন/১০ জুন, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর