২৯ জুন, ২০১৭ ১৮:৩৫

শোলাকিয়া মাঠেও নামাজ ‘মানত’ করা হতো

মো: আবদুল মান্নান

শোলাকিয়া মাঠেও নামাজ ‘মানত’ করা হতো

ফাইল ছবি

আমাদের শোলাকিয়া’র ঈদ জামাত নিয়ে নানা কিংবদন্তি রয়েছে। গোটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষের কাছে এ ঈদগাহ্ নিয়ে গল্পের শেষ নেই। শৈশবে আমরা দেখেছি, জেলার বিভিন্ন স্থানের ধর্মপ্রাণ মানুষ শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায় করার লক্ষে পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে, এই মাঠে পর পর তিনবার নামাজ আদায় করতে পারলে এক হজ্বের ফজিলত পাওয়া যায়।

স্বাধীনতা পূর্বকালে দেখেছি, আষাঢ়-শ্রাবণে ঈদ হলে ভাটি অঞ্চল থেকে শত শত মানুষ নৌকাযোগে ভোর রাতে আমাদের বাড়ির সামনে নৌকা ভিড়িয়ে ট্রেন ধরার জন্য মানিকখালী স্টেশনে দৌড়াত। খুব সকালের এই ট্রেনটিই ছিল সকলের আশা ভরসা। মিস্ করা মানে ঈদ মিস্। ঈদের দিনের ঐ লোকাল ট্রেনটি মানুষের আড়ালে ঢাকা পড়তো। দূর থেকে মনে হতো মানুষের বোঝা নিয়ে একটি অবাক জন্তু দৌড়ে যাচ্ছে। শোলাকিয়ার মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করতো না। 

শোলাকিয়া গমনকারি এসব মুসল্লি যখন নৌকা রেখে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে যেতো নৌকাগুলো কোথায় কার জিম্মায় রেখে যেতো তার কোন হদিস ছিল না। ঐসব খোলা নৌকায় তখন কোন মাঝি থাকতো না। সবাই মাঝি হয়ে এসে নৌকায় দাঁড়-বৈঠা ফেলে ট্রেনে উঠে যেতো। শোলাকিয়ায় জামাত পড়ে দিনভর কিশোরগঞ্জ শহর দেখে রাতের ট্রেনে ফিরে যে যার মত নৌকা নিয়ে বাড়ি যেতো। তখন এসব নৌকা চুরি হতো বা হারিয়ে যেতো বলে শুনিনি। এর একটি কারণ বোধ হয় এমন ছিল যে, শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে যাওয়া মুসল্লিদের নৌকার কোন ক্ষতি বা চুরি করলে মস্ত বড় পাপ হবে। তখনকার দিনে চোরের মনেও যেন খানিকটা পাপবোধ কাজ করতো।

ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর বা শেরপুর থেকেও তৎকালিন সময়ে আত্মীয়স্বজনরা শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে যোগ দিতে আসতো। অনেককে বলতে শুনেছি, বহু বছর থেকে তারা ইচ্ছে পোষণ বা বাসনা করে আসছে এই মাঠে নামাজ আদায় করবে। পীর-দরবেশের মাজারে বিভিন্ন রকম ‘মানত’ করার মত শোলাকিয়া মাঠেও নামাজ ‘মানত’ করা হতো। সেকালে কোন কোন দম্পতি পুত্র সন্তানের আশায় এরকম ‘মানত’ করেছে যে, তাদের ছেলে সন্তান হলে তাকে সঙ্গেঁ নিয়ে শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবে। এবং যথারীতি তারা তা পালন করেছে।

সাধারণ মানুষের গভীর আস্থা, বিশ্বাস আর ভালবাসার এক অসাধারণ তীর্থস্থান ছিল মাঠটি। বিগত প্রায় দু’শ বছরের অধিক পুরনো শোলাকিয়া এ রকম কত যে জনশ্রুতি ও গল্প-গাঁথার জন্ম দিয়েছে তা এখনকার প্রজন্মের কাছে হয়তোবা নিতান্ত গুরুত্বহীন এক কল্প কথা হতে পারে। তথাপি অর্ধশতাব্দি পূর্বের প্রায় যোগাযোগবিছিন্ন হাওর, বাউর, জলাশয় আর নিম্নাঞ্চলকবলিত এই জনপদের সবচেয়ে আলোচিত, আলোড়িত ও অংহকারের নাম এই শোলাকিয়া’র ঈদগাহ্।

বিগত ক’বছরে শোলাকিয়া মাঠে জমায়েত কম হয়েছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন। এর পেছনে অবশ্য নানা কারণ রয়েছে। আমার কাছে অন্যতম প্রধান কারণ মনে হয়েছে কিশোরগঞ্জের স্থানীয় মুসোল্লিগণের একটি বড় অংশ মাঠে নামাজ আদায় করতে না যাওয়া এবং তাদের উদাসিনতা। 

শোলাকিয়া মাঠের পাশে বসবাসকারী দু’চারজন আত্মীয়কে ঈদের দিন ফোন করে জানতে চাইলে তারা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ-ই-সমজিদে নামাজ আদায় করেছেন বলে জানান। অথচ এরা প্রতিদিন সকাল-বিকেল মাঠের ওয়াক্ওয়ে ব্যবহার করে হাঁটতে যান। এমনকি নিজেদের নানা কাজে মাঠ ব্যবহার করে থাকেন। এই অবহেলা আর উন্নাসিকতার কোন মানে হয় না।

লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় শহর কিশোরগঞ্জের অন্ততঃ চল্লিশ হাজার মুসল্লিকে এই ঐতিহাসিক মাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই মহতি উদ্যোগ নেয়া এখন জরুরী। কোন অজুহাতেই তারা বছরের পবিত্র দু’ঈদ-জামাতের জন্য শোলাকিয়ার বিকল্প কোন স্থানকে বেছে নিতে পারেন না। তাদের আন্তরিক ভালবাসা, আবেগ আর নিজ জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণই পারে শতাব্দি থেকে শতাব্দি অবধি বিস্তির্ণ সবুজ এ মাঠের গৌরবময় ঐতিহ্য ধারণ করে রাখতে।

এ বছর দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ময়দান এবং ঈদ-উল-ফিতরের জামাত নিয়ে যে ধরণের প্রচার-প্রচারণা মিডিয়া কভারেজ এমনকি দেশের বাইরেও প্রকাশ করার চেস্টা করা হয়েছে তা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। ঈদের জমায়েত বড় হতে পারে। তবে তা নিয়ে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামার প্রয়োজন আছে কী? প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ফ্রি যানবাহন সরবরাহ করে মুসল্লি আনা হয়েছে। তবু ময়দানের সিংহভাগ ফাঁকাই ছিল। বাস্তবে এটা হয় না। তাছাড়া ইতিহাস সব সময় স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই রচিত হয়। কৃত্রিমতা কখনো ইতিহাসের মৌলিক অংশ হতে পারে না।

কাজেই এ ধরণের অপচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। ইতিহাস হওয়ার জন্য সময়ই সবচেয়ে বড় নিয়ন্তা।
আসুন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের কল্পলোকের এই আদি ও অকৃত্রিম শোলাকিয়া এবং ঈদের বৃহত্তম জমায়েতকে ভাটি বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে রাখি। সবাই একটি কথা মনে রাখি, মানুষের ঐক্য, দেশপ্রেমবোধ এবং স্বতঃপ্রনোদিত জোয়ারই সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের কাছে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

লেখক : সরকারি কর্মকর্তা

(মো: আবদুল মান্নানের ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)

 


বিডি-প্রতিদিন/ ২৯ জুন, ২০১৭/ আব্দুল্লাহ সিফাত-৮

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর