২৩ জুলাই, ২০১৭ ১০:৫৩

জীবনটাই যখন একটা জুয়া খেলা

সুলতানা রহমান:

জীবনটাই যখন একটা জুয়া খেলা

হোটেল বারগাডা। আটলান্টিকের পাড়ে নিউজার্সির ৪৩ তলা হোটেলটির ৩৭ তলায় আমাদের রুম। এতো উচুতে এই প্রথম, লিফটে উঠতে সময় লাগে মোটে ত্রিশ সেকেন্ড! সাদাকালো রুমটির স্বচ্ছ কাচের দেয়াল আড়াল করেনি আটলান্টিকের নীল জলরাশি। সি ভিউ রুমের একদিকে দেখা যায় সমুদ্রের ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আরেকদিকে শান্ত বে। নিরুত্তাপ। 

প্রকৃতির এতো আয়োজনের কোনো বালাই নেই হোটেলটির নিচ তলায়। সেখানে ক্যাসিনো। কত যে মানুষ, আর কত যে টাকার খেলা! সব হারিয়ে রিক্ত হয়ে ফেরে অনেকে, কেউ কেউ বনে যায় কোটিপতি। একটা টেবিলের সামনে দাড়ালাম অনাহুতের মতো। জানলাম তাসের খেলাটির নাম ব্ল্যাক জ্যাক। ক্যাসিনোর হয়ে যে খেলছে একটু পর পর টেবিল খালি করে মূদ্রাসম গুটি চলে যাচ্ছে তার হাতে। জুয়ারীরা কেউ কেউ আফসোস করছে, কেউ নিরব, কেউ পাকা খেলোয়ারের মতো পরের দানের অপেক্ষায়। 

আমি অন্য টেবিলে গেলাম, দুই নারী দুই পুরুষ জুয়ারী। বিশাল হল রুমের মতো ক্যাসিনোটির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যতটা দেখা যায় তাতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জুয়ারীদের অন্তত এক তৃতীয়াংশ নারী। তাও আবার মধ্য বয়সী থেকে প্রবীন নারী। তারা যে ধনীক শ্রেণির নারী তা বোঝা যায় সহজেই। 

সৌম্য শান্ত সম্ভ্রান্ত চেহারার এক নারী জুয়ারীর টেবিলের সামনে দাড়ালাম। তার বয়স ষাটোর্ধ হবে। তর্জনীতে বড় সাইজের পান্না, অনামিকায় দুই জোড়া ডায়মন্ড। স্থির চোখে এক মনে ব্ল্যাকজ্যাক খেলছে। তার সামনে হাজার পাচেক ডলারের গুটি। প্রতি দানে তিনশ' ডলার বাজি ধরে হারছেন। তার সামনের চেয়ারে এক তরুন। মাথায় ইহুদিদের গোল টুপি। তাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। প্রতিবার হারের পর 'দিস ইজ নট গুড' বলে মাথা এদিক ওদিক নাড়ে। ওদিকে নির্বিকার খেলে যাচ্ছে ক্যাসিনোর এজেন্ট! সেও নারী। তবে হলিউডের সিনেমায় ক্যাসিনোতে যেমন সেক্সিস্ট নারী দেখা যায়, তেমন তো নয়ই। পুরোদস্তুর পেশাদার। শোভন ইউনিফর্মের আড়ালে কঠোর জুয়ারী নারী। পাশার দান কেবল তার ভাগ্যেই ঘোরে। তবু তার চোখেমুখে কোন খুশির চ্ছটা নেই। হারতে থাকা তরুণটি যখনি বলে 'দিস ইস নট গুড' বিনিময়ে ক্যাসিনো নারী বলে-ইয়া, নট গুড ফর মি টু, ইটস নট মাই মানি!

ধীর গতিতে আরেক টেবিলে গেলাম। সেখানে বেশ শোরগোল। সালোয়ার কামিজ এবং শাড়ি পড়া দুই নারী দেখলাম। তারাও আমার মতো দর্শক মনে হলো। তাদের বাংলা কথোপকথনে বুঝলাম বউ শ্বাশুড়ি, বেড়াতে এসেছে। পুত্রবধূ শ্বশুড়িকে খেলার জন্য অনুরোধ করছে। নম্বরের খেলা। শূন্য থেকে ৩৬ পর্যন্ত যেকোনো নম্বর ধরতে হবে। গুটি সেই নম্বরে থামলে জিত, নয়তো হার। মনে হলো সবচেয়ে সহজ খেলা। ন্যুনতম ১৫ ডলারের খেলা। 

শ্বাশুড়ি পাঁচ ডলার করে তিনটি নম্বর বাজি ধরে হেরে গেলেন। বউয়ের সঙ্গে কপোট রাগ দেখালেও তাকে খুশিই মনে হলো! জীবনটাই যখন একটা জুয়া খেলা, সত্যিকারের জুয়া একটু খেলাই যাকনা! একশ ডলারের গুটি কিনলাম। সঙ্গে সত্যিকার জুয়ারী। বললাম-জিতলে আমি হারলে আপনি! নাদানের মতো ব্ল্যাকজ্যাকের টেবিলে বসলাম। হারি জিতি, হারি জিতি, হারি জিতি-করতে করতে পুজি একশ ডলার উঠতেই তা আলাদা করলাম। এরপর দেড়শ' ডলার হতেই খেলা রনে ভঙ্গ দিয়ে টেবিল ছেড়ে দিলাম। এবার নম্বরের টেবিলে গিয়ে আচমকা ২৯ নম্বর ধরলাম। ১৫ ডলার খেলে ১৭৫ ডলার পেলাম! 

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! সত্যি নাকি আমি ভুল বুঝছি! ডিলার আমার আমতা ভাব দেখে বিষ্ময় মিশ্রিত বিরক্তি প্রকাশ করলো। তিনশ' পচিশ ডলার জিতে ব্যাপক উত্তেজনা নিয়ে ৩৭ তলার রুমে ফিরলাম!

লেখিকা: প্রবাসী সাংবাদিক

(লেখিকার ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)


বিডি প্রতিদিন/২৩ জুলাই ২০১৭/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর