১১ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:৫৩

কুমিল্লার হাজি আব্দুল মালেক

আনিসুর রহমান

কুমিল্লার হাজি আব্দুল মালেক

হাজি আব্দুল মালেক

আমার দেখা একজন খাঁটি মুজিব প্রেমিক এবং সৈনিক হাজি মালেক। গত ৩৯ বছর যাবৎ আমি এই মানুষটিকে চিনি। ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির সাথে সংঘর্ষ শেষে, দলীয় কার্যালয়ে কাংগালী ভোজ শেষে, বিকাল বেলায় আমি প্রথম বার উনার বাড়িতে যাই। বঙ্গবন্ধুর সাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে উনি গরু জবেহ করে দলীয় কর্মীদের দাওয়াত করেছিলেন।

সেদিনই জানলাম এ মানুষটি সম্পর্কে। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি ১৫ই আগস্ট একটি করে গরু জবেহ করে কাংগালী ভোজ করে এসেছেন। অথচ একজন স্বশিক্ষিত গরিব মানুষ তিনি।

জীবনে এক দিনের জন্যেও মুজিব কোর্ট খুলেননি তিনি। শীত, গরম বার মাস একই পোশাক পরে থাকেন এই হাজি মালেক।

সদর দক্ষিণ থানার গোয়াল মথনের উনার বাড়িতে যাননি, এমন আওয়ামী লীগ নেতা কমই আছেন কুমিল্লা জেলায়। মরহুম কালাম মজুমদার সাহেব সবচাইতে বেশি মূল্যায়ন করতেন এ মানুষটিকে। ১৫ আগস্টের শত ব্যস্ততার মাঝেও হাজি মালেকের বাড়িতে যাওয়া কখনো বাদ দিতেন না তিনি।

কালাম ভাইয়ের এবং আফজল খান সাহেবের সাথে ১৯৮৯সালে দ্বিতীয় বার তার বাড়িতে যাই আমি। কালাম ভাই আমাকে বলেছিল, এই মালেক একজন খাঁটি মানুষ - চিনে রাখ। ১৯৭৬ সালে যখন কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম নেয় না ভয়ে, তখনও সে ১৫ই আগস্ট পালন করেছে।

এই হাজি মালেকের বাড়িতে গিয়েছেন জননেতা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, আব্দুল মতিন খসরু, মরহুম খোরশেদ আলম সুরুজ, মরহুম জয়নাল আবেদীন ভূইয়া, মুজিবুল হক মুজিব, লোটাস কামাল, মরহুম আব্দুল হাকিম, নাসিমুল আলম নজরুলসহ অনেকেই।

কিন্তু এই মানুষটিকে আওয়ামী লীগের কোনো কমিটির সদস্য করার কথা কখনো কারো চিন্তাতেই আসেনি। তাই এখনো পর্যন্ত কোন কমিটির সদস্যও হতে পারেননি তিনি। অবশ্য সেজন্য কোন আক্ষেপও নেই তার।

অকারণেই এ মানুষটি আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন। প্রতিবছরই দাওয়াত দিয়ে যান, কিন্তু আমার যাওয়া হয়ে উঠে না। পরে আমাকে দেখলেই বলেন, নেতা আপনে আমার দাওয়াতে গেলেন না! বুঝি যে তিনি কষ্ট পেয়েছেন, পরের বছর আবারো একই ভুল করি।

২০০৩ সালে হাজি মালেকের ১৫ই আগস্টের গরু পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিএনপির সাবেক এমপি মনিরুল হক চৌধুরী। হাজি মালেক এমপি সাহেবের বাড়িতে গিয়ে বলেছিলেন, মনির ভাই আপনেতো ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, এতো বড় অন্যায় আপনে ক্যামনে করলেন?

মনিরুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, আমার বাড়ীর পাশে তুমি প্রতি বছর এই কাজ করছ, আমিতো শরম পাই। পরে অবশ্য পুলিশকে বলেছিলেন গরু ফিরিয়ে দিতে।

আওয়ামী লীগের সাথে সামান্য সম্পর্কের কারণে বহু মানুষের ভাগ্য খুলে গেছে। অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত ৪১টি গরু জবেহ করা এই গরীব মানুষটির ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি।

দু'দিন আগে আমাকে দাওয়াত দিলেন মালেক ভাই। জিজ্ঞেস করলাম এ বছর কত তম গরু জবেহ হবে, তিনি বললেন, 'ভাই ৪২ নাম্বার'। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, 'মন্ত্রী এমপি কেউ আসবে?' তিনি বল্লেন 'হেতারার সময় কই! আপনে আইয়্যেন। '

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন আমার সাথে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল দেলোয়ার, বর্তমান যুবলীগ নেতা। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মালেক ভাইরে কোন একটা জায়গায় একটা দায়িত্ব দিলি না কেন? উনাকে কি একটু সম্মান দেয়া যেতো না?

দেলোয়ারের উত্তর শুনে আমি হতবাক। সে বলল, 'হাজি মালেক সাহেবকে গোয়াল মথন সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি করার প্রস্তাব করেছিল সে। কিন্তু স্কুলের হেড মাস্টারসহ স্থানীয় প্রভাশালীদের ইচ্ছায় সভাপতি হয়েছেন জামাতপন্থী ব্যক্তি হারুনুর রশীদ!

দলের জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, অনেক বেশী ত্যাগ এ মানুষটির। অথচ তার দিকে কেউ ফিরেও দেখেনি ।

আওয়ামী লীগ যদি কোন দিন আবারো কঠিন সমস্যায় পড়ে , হয়তো অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু হাজি মালেক ১৫ই আগস্ট পালন করবেই। কারণ আমাদের ভালবাসায় ভেজাল থাকলেও, হাজি মালেকের ভালবাসায় কোন ভেজাল নেই।
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/১১ আগস্ট, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর