১৯ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:২৩

'সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, অনুভবে'

রিমি রুম্মান, যুক্তরাষ্ট্র

'সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, অনুভবে'

শৈশবের খেলার সাথী দিনা'কে হিংসে হতো খুব। ওদের কতো বড় পরিবার! নানা-নানু, মা, মামা-খালা সবাই একসাথে একই বাড়িতে থাকে। কি ভয়ানক আনন্দের জীবন ওদের! ভরদুপুরে যখন পুরো শহর নিথর হয়ে থাকতো ক্ষণিকের জন্যে, বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আমি পা টিপে টিপে ছুটে যেতাম। দিনা'র নানাভাইয়ের বড় বাড়ি। ফুলের সুবাসময় বিশাল উঠোন। সেখানে আমরা ছুটোছুটি খেলতাম। অনেকটা খাঁচার পাখি ছাড়া পাবার মত, যেন বিশাল আকাশে ডানা ঝাপটে উড়োউড়ি। 

ওদের ছাদে উঠতাম। যদিও সেখানে উঠবার কোন সিঁড়ি ছিল না। তবুও বিপদজনকভাবে দেয়াল বেয়ে উঠা। ছাদে নুইয়ে থাকা আতাফল গাছের পাকা আতাফল খেতাম। গল্প করতাম। বাড়ির পেছনে গভীর পরিত্যক্ত ডোবা কচুরিপানায় ভরপুর। ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে ভাবতাম, অসাবধানে পড়ে যাই যদি কখনো, কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের। কচুরিপানার নীচেই মৃতদেহ ভেসে থাকবে হয়তো অনাদিকাল সকলের অজানার মাঝে। রেলিংবিহীন সেই স্যাঁতস্যাঁতে ছাদ থেকে ছোট্ট দু'টি শিশু পড়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা এবং কারণ ছিল যদিও।

প্রায়ই দুপুরে বাবা লাঠি হাতে তীব্র বেগে ছুটে আসতেন। দূর থেকে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত আমি ছুটতাম অন্য পথে বাড়ির দিকে। একদিন আমরা পয়সা জমিয়ে 'ছুটির ঘণ্টা' দেখি বাসার পাশের সিনেমা হলে। অন্ধকার হলরুম। পর্দার দৃশ্যকে বাস্তব মনে হতো। ছবিতে 'অনেকদিনের জন্যে স্কুল ছুটি হয়। ছুটির ঘণ্টা বাজে। সবাই বাড়ি ফিরে যায়। ছোট্ট ছেলেটি যেতে পারেনি। সে বাথরুমে আটকে থাকে। ছেলেটিকে পরিবারের সবাই পাগলের মতন খুঁজছে। এইদিকে কাঁদতে কাঁদতে অনাহারে একদিন বাথরুমেই নিস্তেজ হয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।' 

আমি চিৎকার করি, ঐ যে... ওখানে... ও-খা-নে। হলভর্তি মানুষ। কেউ আমার কথা শুনতে পায় না। আমি চেঁচাতে থাকি... চেঁচাতেই থাকি। গলা বসে যায়, জোর কমে আসে। অতঃপর, 'একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো... গানটি ধীর গতিতে বাজতে থাকে। অন্ধকার হলরুমে আলো জ্বলে উঠে। দিনা এবং আমি, আমরা একে অপরের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখি।

ধীরে ধীরে আমরা বড় হই। আমার পরিধি বাড়ে। মফঃস্বলের কলেজ শেষে ঢাকায় ভর্তি হই। দিনা সেই শহরেই থাকে। ওর পরিধি বাড়ে না। বরং সংকুচিত হতে থাকে। নানাভাই, নানু এবং মা মারা যায়। মামা-খালা'দের আলাদা সংসার হয়। ততদিনে আমি বুঝতে শিখেছি, দিনার জীবন আসলে ভয়ানক আনন্দের নয়। ওর বাবা-মা'র সুন্দর সংসার নেই। মা মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই নানার বাসায় থাকে ওঁরা। লোকমুখে শুনেছি, ওর বাবা ভীষণ ভালোমানুষ। যদিও আমি তাকে কখনো দেখিনি।

এক সন্ধ্যায় আঁধার ঘনাবার আগে আমাদের দেখা। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে খানিক বিষণ্ণ দিনা ধরা গলায় বলল, 'রিমি, আমেরিকায় তো নাকি সবাই ব্রেড খায়, ভাত ছাড়া তুই ওখানে ক্যামনে বাঁচবি।' আমি চুপ করে থাকি। বুঝি, সব-ই মায়া। মাঝে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যায়। ততদিনে আমরা দু'জনেই সংসারী। ফোনে বাবার কাছ হতে খবর নেই। ফোন নাম্বার জোগাড় করে একদিন ফোন দেই। সে কি উচ্ছ্বাস! খল্‌বলিয়ে বলে যায় যাবতীয় খবরাখবর। উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন করে যায় অনবরত। আমি কেমন আছি, সুখে আছি কি না, শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কেমন, ওরা আমায় ভালোবাসে কিনা, আপন করে নিয়েছে কিনা...

হাজার হাজার মাইল দূরের এই শহরে সব ব্যস্ততা শেষে সবাইকে খাইয়ে সুনসান নীরব দুপুরে আমি যখন একাকি প্লেটে ভাত নিয়ে বসি, দিনাকে খুব মনে পড়ে। খু-উ-ব। সকলের অগোচরে বিড়বিড় করে বলি, 'দিনা, আমেরিকায় কিন্তু ভাতও পাওয়া যায়। ভাত ছাড়া কি আর বাঙালি বাঁচে রে!"

আমাদের হিরন্ময় স্মৃতিগুলো কালের স্রোতে মিলিয়ে যাবে হয়তো একদিন। বন্ধুর মুখখানিও ঝাপসা হয়ে আসবে হয়তো ভোরের কুয়াশার মতোন। কিন্তু, সম্পর্ক? আমি বিশ্বাস করি, কিছু সম্পর্ক কখনোই শেষ হয়ে যায় না। যোগাযোগ না থাকলেও, হাজার মাইল দূরে থাকলেও সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, অনুভবে।
সবাইকে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।

(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/১৯ আগস্ট, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর