১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০১:৪৪

এর পেছনের গল্পটি সুখের ছিল না মোটেও

রিমি রুম্মান

এর পেছনের গল্পটি সুখের ছিল না মোটেও

আমার প্রায়ই মনে হয়, "বাবা কি মানুষ ছিলেন ? "

বাবাকে মাঝে মাঝে মানুষ মনে হয় না। মনে হয় তিনি মানুষের বাইরে কিছু ।

বাবা ফাইভ/সিক্স পড়ুয়া এক গাঁয়ের বালিকাকে বিয়ে করে শহরে বসতি গড়লেন। সেই বালিকা বধূ আমার মা। পড়ালেখায় সীমাহীন আগ্রহ দেখে মাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন শহরের মাতৃপীঠ গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে। আমার মেধাবী মা ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হতেন। ভয়াবহ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েও স্কুলে শুয়ে এস এস সি পরীক্ষা দিলেন। কৃতিত্বের সাথে পাশ করলেন। চাঁদপুর সরকারী কলেজ থেকে এইচ এইচ সি পাশ করলেনও কৃতিত্বের সাথে। অতঃপর ঘনিষ্ঠজনদের পরামর্শে দীর্ঘমেয়াদি পড়াশোনায় না গিয়ে ভর্তি হলেন তিন বছরের জন্যে প্যারামেডিকেলে। সেই সময়টাতে আমরা পিচ্চি দুইটা বোন বাবা, নানু আর খালার তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছিলাম। ব্যবসার পাশাপাশি বাবা আমাদের সময়মত খাওয়াতেন, গোসল করাতেন, ঘুম পারাতেন। মা থাকতেন ঢাকায় প্যারামেডিকেল হোস্টেলে। মাসের শেষ শুক্রবার ভিজিটর ডে তে বাবা আমাদের নিয়ে লঞ্চে ঢাকায় যেতেন মায়ের সাথে দেখা করাতে। প্রতিমাসের এই দিনটির জন্যে মা ব্যকুল হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন। সারামাস জুড়ে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে হাতে সেলাই করে যে সুন্দর সুন্দর জামা বানাতেন, দেখা হলেই তা পরিয়ে স্টুডিওতে নিয়ে যেতেন। ছবি তুলতেন। শেষে বুকে জড়িয়ে অশ্রুজলে বিদেয় দিতেন। অতঃপর পরবর্তী এক মাস সেই ছবি দেখে দিন কাটাতেন। একটা সময় পড়া শেষ হলে মা ফিরে এলেন। চাকুরিতে যোগ দিলেন।

আমার প্রায়ই মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, 
যখন মাঝে মাঝেই মায়ের অফিসে যেতাম। মাকে দেখতাম গভীর মনোযোগে মাইক্রোস্কোপের বাটন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দু'চোখে কিছু দেখছেন আর পাশাপাশি ফাইলে লিখছেন। ব্যস্ততার মাঝেও অফিসের পিয়ন খালেক কাকাকে পাঠিয়ে হোটেল থেকে পরোটা, রসগোল্লা আনাতে ভুলতেন না। সেইসব খাবার খালেক কাকা খুব যত্নে সুন্দর করে পরিবেশন করতেন। আপ্যায়ন করতেন মায়ের ব্যস্ত থাকার সময়টাতে। চেয়ারে পা দুলিয়ে রসগোল্লার রসে পরোটা ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ছোট্ট আমি খুশিতে মরে যেতে চাইতাম। মাইক্রোস্কোপে মনোযোগী মাকে খুব স্মার্ট এবং সুন্দর দেখাতো। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে জোহরের নামায আদায় করেই মা ডায়নিং টেবিলে বসে যেতেন দুপুরের খাবার খেতে। কেননা, বাবা সহ আমরা তিন ভাইবোন না খেয়ে অপেক্ষায় থাকতাম। খেতে বসে মা মৃদু তিরস্কার করতেন এই বলে, "এতো করে বলি আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকিস না, খিদা লাগলে খাইয়া ফেলিস, কিন্তু কে শুনে আমার কথা !" আমার ধারনা, মা মুখে তিরস্কার করলেও মনে মনে খুশিই হতেন আমাদের এই গভীর ভালোবাসা দেখে। এটি আমাদের পাঁচ সদস্যের সুখি পরিবারের গল্প।

এর পেছনের গল্পটি সুখের ছিল না মোটেও। অনেকেই বাবার কান ভারী করতো এই বলে, বউকে বেশি পড়াইলে এই বউ থাকবো ? কিন্তু আমার বাবা সেসব পরোয়া করেননি। ছয় বছর বয়সে পিতৃহারা হয়েছেন তিনি। লেখাপড়া করতে পারেননি বেশিদূর। মাঝে মাঝে গল্প করতেন, কলাগাছের ভেলায় চড়ে বর্ষার দিনে এক মাইল দূরের স্কুলে যেতেন, হারিকেন কিংবা কুপিতে কেরোসিন কম খরচ করতে দিনের আলোয় পড়তেন। নিজে পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি, তাই আমার মাকে তাঁর স্বপ্ন পূরণের রাস্তায় হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বহুদূর, সাফল্যের শীর্ষে। ভাবা যায়!......

নিউইয়র্কে আমার বাসার পাশেই ওষুধের দোকানে খণ্ডকালীন চাকুরি করে মারিয়া। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় যাবত প্রতিমাসে শাশুড়ির নিয়মিত ওষুধ আনতে যাই সেখানে। ব্যস্ততা না থাকলে আমরা দাঁড়িয়ে গল্প করি ক্ষণিক। জানালো, ছাত্রাবস্থায় অনেক মেধাবী ছিল সে। সংসার, স্বামী, সন্তান সামলে আর পড়া চালিয়ে যাবার সুযোগ হয়নি। স্বামী সহযোগিতা করলে এগিয়ে যেতে পারতো অনেকদূর। অতঃপর বুক কেঁপে কেঁপে আসে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। ভাঙ্গনের শব্দ। হৃদয়ভাঙ্গা এইসব দীর্ঘশ্বাস সংক্রমিত হয় বাতাসে। শীতল বাতাস কেটে কেটে সন্ধ্যার নিয়নের আলোয় পিচঢালা পথ ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরি আমি।

বাবাকে খুব মনে পড়ে। ভালোবাসায় মোড়ানো একটা পৃথিবী বানিয়ে দিতে পারতাম যদি! বাবা কি মানুষ ছিলেন ? মানুষ ? নাকি মানুষের বাইরে অন্য কিছু ?
ভালো থাকুন সকলে...

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।(গত বছর লিখেছিলাম বাবাকে নিয়ে হৃদয়ভেজা লেখাটি।)

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


বিডি-প্রতিদিন/ আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর 

সর্বশেষ খবর