২৩ মার্চ, ২০১৮ ১১:৪২

কারণে-অকারণে কেবলই বিভক্ত হই

আমিনুল ইসলাম, তাল্লিন(এস্তোনিয়া) থেকে

কারণে-অকারণে কেবলই বিভক্ত হই

আমিনুল ইসলাম

কিছুদিন আগে এক বাংলাদেশি ছেলে প্লেনের ভেতর ফ্লাইট চলাকালীন অবস্থায় জামা-কাপড় খুলে ফেলে উল্টো-পাল্টা কি যেন করছিল, সেই খবর আবার ছাপা হলো দেশের পত্র-পত্রিকায় ছেলেটার পাসপোর্টের ছবি'সহ।

ওই পাসপোর্টে ছেলেটার জন্মস্থান নোয়াখালী লেখা ছিল। তো, আমরা বাংলাদেশিরা ছেলেটার ওই কর্মকাণ্ডকে নোয়াখালী জেলার সঙ্গে মিলিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করলাম। অর্থাৎ তার বাংলাদেশি পরিচয়টার চাইতে নোয়াখালী পরিচয়টাই বড় হয়ে দেখা দিল!

এইতো সেদিন'ই শ্রীলংকায় তিন জাতি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ফাইনালে লিটন দাস আর সৌম্য সরকার খুব একটা ভালো করতে পারেনি। আমাদের মাঝে কিছু দর্শক তাদের ক্রিকেটার পরিচয় ভুলে গিয়ে ধর্মীয় পরিচয় সামনে নিয়ে আসলো। এদের প্রশ্ন হচ্ছে- এরা এতো দিন ধরে জাতীয় দলে চান্স পাচ্ছে কি করে? নিশ্চয় ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য! অনেকটা "হিন্দু কোটা" টাইপ ব্যাপার! চিন্তা করে দেখেন অবস্থা!

এক ছেলে এই কিছুক্ষণ আগে মন খারাপ করে তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছে, এক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম একটা চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য। ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে উনারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কই থেকে পাশ করেছি? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি শুনে বোর্ডে থাকা তিনজন নিজেরা নিজেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলেন। নিজদের হাসাহাসি শেষে আমাকে আর তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। এক মাস ধরে নেয়া আমার প্রস্তুতিটাই মাটি হয়ে গেল।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়টাই বড় হয়ে গেল। সেও যে ছাত্র এবং অন্য আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মতোই তাকেও বিবেচনা করে এরপর যাচাই করা উচিত সেটাই আমরা ভুলে বসলাম।

এই বয়েসেই আমার সৌভাগ্য হয়েছে পৃথিবীর নানান প্রান্ত ঘুরে বেড়ানোর। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষণার কারণে নানান সেমিনার ও কনফারেন্সে আমাকে অংশগ্রহণ করতে হয়। এইতো কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে। অচেনা-অজানা এক বাংলাদেশি, যার সঙ্গে স্রেফ ফেসবুকে অতি অল্প সময়ের পরিচয়, সেই মেয়েটা আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসলো। শুধু তাই না, সঙ্গে করে তার এক ছোট ভাইকে নিয়ে আসে। কারণ ওই ছোট ভাইয়ের গাড়ি আছে; যাতে করে এয়ারপোর্ট থেকে তার গাড়ি করে হোটেলে যাওয়া যায়।

ওই ছোট ভাইকে তো আমি জীবনেও দেখিনি বা চিনি না। অথচ এয়ারপোর্টে পরিচয় হওয়ার পর যে কয়েকদিন অকল্যান্ডে ছিলাম, প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটা হাজির হয়েছে তার গাড়ি নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরেত নিয়ে যাওয়ার জন্য। কই এই ছেলেটা কিংবা মেয়েটা তো আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেনি- আমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, আমার জন্ম কোন জেলায় কিংবা আমি কোন ধর্মে বিশ্বাসী? কেবল আমার বাংলাদেশি পরিচয়টাই আমাদের এতো অল্প সময়ে এতো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

এইতো সপ্তাহ খানেক আগে আমি যেই শহরে থাকি, এই শহরের তিন বাংলাদেশি ছেলে বলা নেই, কওয়া নেই আমার বাসায় উপস্থিত। এদের মাঝে দুই জনের নাম-পরিচয় কোনো কিছুই আমি জানতাম না। বাকী একজনের সঙ্গে এর আগে বাসের ভেতর অতি অল্প সময়ের পরিচয় হয়েছিল। তো এই তিন ছেলে এক সন্ধ্যায় বাসায় এসে উপস্থিত।

অচেনা-অজানা এই তিন ছেলে আর আমি মিলে আমার বাসায় এমনভাবে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আমার তো মনে হচ্ছিলো আমাদের অনেক বছরের চেনা-জানা! এর মাঝে এক ছেলে তো এতো চমৎকার করে কথা বলছিল- আমার মনে হচ্ছিলো আমরা বোধ হয় ঘণ্টা খানিকের পরিচয়ে বন্ধু হয়ে গিয়েছি।

আমর জানা নেই, পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব হবে কিনা- একদম অচেনা-অজানা কেউ কাউকে নিজ বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে এবং এভাবে মুহূর্তেই বন্ধুর মতো কথা বলা শুরু করে দিচ্ছে! কই, সেদিন তো আমরা কে কোনো জেলা থেকে এসেছি, কে কোথায় পড়াশুনা করেছি, কার কি ধর্মীয় পরিচয় সামনে এসে ধরা দেয়নি! স্রেফ আমাদের বাংলাদেশি পরিচয়টাই আমাদের এতো অল্প সময়ে কাছে নিয়ে এসেছে।

সেবার যখন ইতালির ভেনিস শহরের একটা পিৎজা শপে ঢুকে পিৎজা খাবার সময় আমার একটা ফোন কল এসছিল দেশ থেকে; তখন বাংলাতেই কথা বলছিলাম বেশ জোরে জোরে। ফোনে কথা বলা শেষে পিৎজা খেয়ে যখন বিল দিতে যাব, তখন দোকানের ছেলেটা ইংরেজিতে বলল, তোমাকে বিল দিতে হবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? তুমি বোধ হয় বাংলাদেশ থেকে এসেছো। আমাদের দোকানে যে পিৎজা বানায় সেও বাংলাদেশি। সে তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে মানা করেছে।
 
আমি কি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? ভদ্রলোক সামনে বের হয়ে বললেন, আপনি জোরে জোরে বাংলাতে বোধ হয় দেশে থাকা আপনার মা'র সঙ্গে কথা বলছিলেন। আপনার কথা শুনে মন'টা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। আমি তাই আমদের ক্যাশিয়ারকে বলেছি, আপনার বিলটা যেন না রাখে।

আমি পিৎজা শপ থেকে বের হওয়ার সময় ভাবছিলাম- এই লোককে আমি চিনি না, জানি না। তিনিও জানেন না আমি বাংলাদেশের কোন জায়গা থেকে এসেছি, আমার পড়াশুনা কোথা থেকে কিংবা আমার ধর্মীয় পরিচয় কি। স্রেফ বাংলাতে কথা বলছিলাম, সেই বাংলাদেশি পরিচয়টাই তো তার মনটাকে বিচলিত করেছে; আবেগে ভাসিয়েছে।

আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, তাহলে কেন আমরা কারণে-অকারণে কেবলই বিভক্ত হই! রাজনৈতিক, ধর্মীয়, পেশাগত, শিক্ষা, জেলা আরও কত কারণেই না আমরা বিভক্ত হচ্ছি! আবার মাঝে মাঝে মনে হয়- তাহলে এই যে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে এতসব বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে; কই, তখন তো এত সব পরিচয় সামনে এসে হাজির হয়নি! স্রেফ একটা পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল!

এই অংকটা বোধ হয় বেশ কঠিন। সূত্রে ফেলে সমীকরণ যে মিলতেই চাইছে না!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/২৩ মার্চ, ২০১৮/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর