১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ১২:১৯

ইন্টারভিউ

আমিনুল ইসলাম, তাল্লিন (এস্তোনিয়া) থেকে

ইন্টারভিউ

বছর ছয় কি সাতেক আগে বোধ করি এই সময়টাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম।

মাত্রই সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে ঢাকার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি; সেই সঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং বুয়েটেও আবেদন করেছি শিক্ষকতার জন্য।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা ঢাকাতে। এক অর্থে আমরা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সেই আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য মনস্থির করলাম; আমার বড় বোন, সে নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে; আমাকে এসে বলল, 

-তোর এই সিদ্ধান্তটা ঠিক হচ্ছে না, তোর উচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানেই আমাকে বাসায় থেকে পড়াশুনা করতে হবে; তাই ভাবলাম সিলেটে গিয়েই পড়ি। এছাড়া পরীক্ষা দিতে গিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটা এতো চমৎকার লেগেছিল; তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; আমি এখানেই পড়বো।

সিলেট থেকে পড়াশুনা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান স্টাডিজে মাস্টার্স করতে চলে যাই; সেখানে দুই বছরের মাস্টার্স শেষ করে একটা রিসার্চ প্রোজেক্টে, রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে বছর দুয়েক কাজ করে দেশে ফিরে ঢাকার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করি, সেই সঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর বুয়েটেও আবেদন করি শিক্ষকতার জন্য।

তো, গেলাম গেলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি'তে ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ নিতে সামনে বসে থাকা একজন শিক্ষক বললেন,

- আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেননি; সিলেটে পড়াশুনা করেছেন। আপনার উচিত হবে সেখানে আবেদন করা।

আমার সত্যিই জানা ছিল না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র হতে হবে।

আমি সিলেটে আবেদন করিনি, কারণ আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই ঢাকাতে থাকেন। আমাদের বাসা ঢাকাতে। এছাড়া সিলেটে তো অনেক দিন ছিলাম'ই। তাই ভাবলাম ঢাকাতেই আবেদন করি।

এরপর গেলাম বুয়েটে ইন্টারভিউ দিতে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সটারনাল এসেছে  ইন্টারভিউ নিতে। তিনিও বলে বসলেন

-ও আচ্ছা, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি! তাহলে এখানে আবেদন করেছেন কেন?

এখানে অবশ্য আমি উল্টো তাদের প্রশ্ন করে বসেছিলাম,

-আপনাদের সার্কুলারে কোথাও তো লেখা ছিল না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া আবেদন করতে পারবে না। আপনারা তো লিখে দিলেই পারতেন, তাহলে আর আবেদনই করতাম না।

এরপর এরা আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

আমি শুনেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তাও দুই একজন বাইরের শিক্ষক আছে। জাহাঙ্গীরনগরে নাকি তারা ভুলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে নিতে চায় না!

আমাদের সমাজে অবাক করা সব ব্যাপার চালু আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েট অতি অবশ্যই দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এর মানে তো এই না, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনা করে না, কেউ কিছু জানে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা অন্যতম ফাংশন হচ্ছে- তার ছাত্র-ছাত্রীদের মন-মানসিকতাকে বিকশিত করা; উদার করা; যে কোন কিছুকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা। আর আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়- আমরাই সেরা। আমাদের চাইতে ভালো আর কেউ হতেই পারে না!

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েট না; অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতেও একই ব্যাপার চালু আছে।

ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মনে করে এরা টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনে! আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধরুন যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে, তাদেরকে ক্ষেত, 'আনস্মার্ট' মনে করে!

অর্থাৎ যে যেভাবে পারছে অন্যকে ছোট করার চেষ্টা করছে। আমার সব সময়ই মনে হয়- অন্যকে ছোট করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে আমরা বাংলাদেশিরা জন্মেছি।

আমি আমার অনেক লেখাতে অক্সফোর্ডে পড়তে যাবার কথা লিখেছি। আবারও লিখতে হচ্ছে। সেবার যখন আমি এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গেলাম ছয় মাসের জন্য; এরা আমাকে কখনোই জিজ্ঞেস করেনি- তুমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছ? সেখানে কি আদৌ পড়াশুনা হয় কিনা? তারা আমাকে যাচাই করেছে।

আমি অক্সফোর্ড থেকে পড়ে চলে এসেছি অনেক বছর আগে। বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবে নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য বলতে হচ্ছে।

আমার খুব ইচ্ছে আছে আমি আবার অক্সফোর্ডেই ফেরত যাবো সেখানকার শিক্ষক, গবেষক কিংবা যে কোনো ধরনের একাডেমিক পোস্টে। নিজেকে সেভাবেই তৈরি করছি।

আমার এই ইচ্ছের কথা বলার কারণ হচ্ছে- আমি জানি, আমি যদি আমার নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে পারি, আমার যদি সত্যিই যোগ্যতা থাকে; আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কিংবা গবেষক হিসেবে জয়েন করতে পারবো। তারা আমার যোগ্যতা যাচাই করবে। বলে বসবে না- আরে আপনি তো সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন, কিংবা সুইডেনে পড়াশুনা করেছেন; সেখানেই যান না কেন!

তবে বলতেই হচ্ছে, আমি সত্যিই জানি না; আমার হাজারো যোগ্যতা থাকার পরও নিজ দেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট আমাকে গ্রহণ করবে কিনা!

এটাই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এই যে ছেলে-মেয়েরা এখন আর পড়াশুনা করতে চায় না; এর একটা অন্যতম কারণও কিন্তু এটাই। কারণ এরা জানে, দিনশেষে তার যোগ্যতা হয়ত যাচাই করা হবে না। যাচাই করা হবে অন্য কিছু! কিংবা এই কারণেই হয়ত আমরা ক্রমাগত অন্যকে ছোট করে বড় হবার চেষ্টা করি।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/১৮ এপ্রিল, ২০১৮/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর