১৪ জুলাই, ২০১৮ ১১:২০

অজানা সেই নায়ক, যাদের ঠাঁই মেলে না ইতিহাসের পাতায়!

ইফতেখায়রুল ইসলাম

অজানা সেই নায়ক, যাদের ঠাঁই মেলে না ইতিহাসের পাতায়!

সর্বমোট তিন লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার দুইশ (৩,৪৯,২০০) ঘণ্টা! মাসে রুপান্তর করলে হয়ে যায় ৪৮৫ মাস আর বছরে দাঁড়ায় মোট ৪০ বছর ০৫ মাস! আপনার কাছে মনে হতে পারে হঠাৎ সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা কেন? আপনি যেখানে সংখ্যা দেখেন জাহাঙ্গীর সেখানে দেখেন পাওয়া না পাওয়ার বেদনা। দেখেন রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিজের এক দীর্ঘ সময়ের পথচলা... এই দীর্ঘ সময় পর তবুও তিনি জীবনকে রঙিনই দেখেন!

৪০ বছর ০৫ মাস ধরে জাহাঙ্গীর শুধু পরিবারের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাটুকুই করে গেছেন! নাহ তাঁর জীবনে ছেলের প্রথম জন্মদিন, ছেলের প্রথম মুখে খাবার, ছেলের প্রথম স্কুল যাওয়া, ছেলের প্রথম পরীক্ষা বলতে কিছুই নেই, ছিল না! পরিবার ও নিজের জীবনের বহু প্রথম থেকে জাহাঙ্গীর নিজেকে ও পরিবারকে বঞ্চিত করেছেন!

কে এই জাহাঙ্গীর? নাহ এই সমাজের উঁচুতলার কেউ নন, পদমর্যাদায় এমন কোনো পদেও ছিলেন না যাকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে! আমি তবুও তাঁর কথা বলতে চাই...

মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন কনস্টেবল হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন জাহাঙ্গীর! দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ঘাত প্রতিঘাত পার করা জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন সময়ের পরিবর্তনের সাক্ষী। তাঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি ডেমরা জোনের অধীনে কর্মরত ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় পুলিশের ধনাত্মক পরিবর্তনে তিনি অনেক খুশি।

হাজতে গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর সাথে কথা হয়েছিল একদিন, আমার বাবার বয়সী জাহাঙ্গীর পুলিশের চাকরিতে যোগদান করে খুশিই হয়েছেন। তিনি বলেন "পরিবাররে সময় দিতে পারি নাই, দেশের জন্য কাজ করছি তাই কষ্ট নাই স্যার। তবে মানুষ ভাল-মন্দ মিলায় ফেলে, গালি দেয়! অনেক সময় কষ্ট লাগতো স্যার। অপরাধ না কইরাও অপরাধী হইতে হয় অনেক সময়"! চাকরিটাই এমন!!

তাঁর মতে, "আমাগো যতটুকু খারাপ তাঁর পুরো দায় আমাগো একার নাহ, এই সমাজের মানুষগুলা বুকে হাত দিয়া স্যার যখন কইতে পারে না তারা সবাই ১০০ ভাগ সৎ, সেই একই সমাজের পুলিশ সবাই ১০০ ভাগ সৎ হইবো কেমনে? তারা কেমনে চায়? আমরা তো এই সমাজেরই লোক! সমাজে ভাল-মন্দ মিলায়া মানুষ, আমাগোও তাই! বরং আমাগো ভুল হইলে সিনিয়র স্যারগো দেয়া শাস্তি থাকে, আমরা বরখাস্ত হই, ফৌজদারি অপরাধ করলে বিভাগীয় ও আইনি শাস্তি পাই। এই সমাজের বহু মানুষ বহু আকাম কইরাও সাধু সাইজা থাকে, তাগো কথা আলোচনায়ও আসে না। অপরাধ স্যার সবাই করে, খালি আমাগো নাম পড়ে বেশি বেশি! আমাগো ইউনিফর্ম আছে, বাকি সবাই ইউনিফর্ম ছাড়া! তাও স্যার কত শত স্যারেরা হালাল উপার্জনে চলে তা আমরা জানি, বাইরের মাইনষে খালি এক পাল্লায় মাপে স্যার কিছু খারাপের জন্য সবাইকে গালি দেয়! যে স্যারেরা সৎ থাকে তাদেরও নানান বিপদ; উপরতলার অসাধু মানুষ তাগো বিপদে ফেলতে উইঠা পইড়া লাগে। কোথায় যাইবো স্যার। আপনিতো স্যার নিজে সরাসরি দেখেন, একপক্ষে রায় দিলে অপরপক্ষ আপনারে দেখতে পারে না ! আমাগো সমাজের ৫০ ভাগ আমগো সবসময় দেখতে পারে না! ভাল কাজকাম করলে কয় দেখানের জন্য করছে, না করলে কয় এগুলো মানুষের জাত না! যারা আঙ্গুল তোলে স্যার তাঁরা অপরাধ না করলেতো আমাগো দরকারই আছিলো না স্যার! নিজের আঙ্গুল পরিষ্কার না কইরা, অবস্থা পরিবর্তন না কইরা খালি ব্যক্তি অফিসাররে দোষ দেয় স্যার! আমার এই দুই চোখ বহুত মানুষের আকাম-কুকাম দেখছে; তারপর হেগোই ( তাদের) বড় বড় বুলি শুনছি স্যার! আমাগো পোলাপান বলে মানুষ হয় না স্যার, আমি কনস্টেবলের দুই পোলা মাস্টার্স কইরা ভাল চাকরি করে, আমি কি মানুষ করি নাই স্যার! আল্লাহ সবকিছুর সাক্ষী স্যার, আমাগো স্যারগো অনেকে খারাপ অফার নিয়া আসলে বহুত স্যারেরা লাথি মেরে ওই অফার ফিরায় দেন। আমার নিজের কান, চোখ সাক্ষী স্যার! এই যে সৎ অফিসারগো নষ্ট করতে আসে, হেরা কারা স্যার। এই সমাজের বাহিরের কেউ?

৪০ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ জমানো কথা দশ মিনিটেতো শেষ হওয়ার নয়; একটি উপন্যাসও বোধকরি যথেষ্ট নয়! আমার ভাবনার জগতে খোরাক এনে দেয় কনস্টেবল জাহাঙ্গীর এর কথা! তিনি এমন অনেক কিছুই দেখেছেন, যা অনেকে ইচ্ছে করে দেখতে চায় না, কারণ গভীরভাবে গভীরতাকে ছোঁয়ার অভিরুচি আমাদের নেই। আমরা ভীষণ অস্থির আর আমাদের অস্থিরতা, সময়টাকেও ক্রমশঃ অস্থির করে চলেছে!

জীবন যুদ্ধে নিজের দুই ছেলেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করিয়েছেন জাহাঙ্গীর! দুজনই চাকরি করেন। একজন দেশের বাইরে সরকারি চাকরি করে প্রায় ১ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন, অন্যজন দেশে ভাল অবস্থানে আছেন!

জাহাঙ্গীরেরা দেশের জন্য কাজ করে পরিবারের বঞ্চনাকে সামনে না এনে দেশকেই ভালবেসে যেতে চায়। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের হয়তো ঠাঁই মেলে না, তারা রয়ে যান সহকর্মীদের অশ্রুসজল বিদায়ে, থেকে যান পরিবার ও সহকর্মীদের হৃদয়ের মনিকোঠায়।

জাহাঙ্গীরেরা থাকুক না পরিবার ও স্বজনের নায়ক হয়ে; ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নাইবা মিললো (এক জীবনে এটুকুইবা কম কিসে)।

লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন)
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/১৪ জুলাই, ২০১৮/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর