১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১৯:৪০

নিজের দেশকে চমৎকার ভাবে তুলে ধরার মাঝেই এদের যত আনন্দ

আমিনুল ইসলাম

নিজের দেশকে চমৎকার ভাবে তুলে ধরার মাঝেই এদের যত আনন্দ

শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢাকা ছোট্ট এই শহরে বিজয় দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো শহরটা'র জনসংখ্যা'ই সাড়ে চার লাখের মতো হবে। ছোট্ট এই শহরে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনের সংখ্যা সব মিলিয়ে হয়ত শ'দুয়েক হবে। 

শহরে'র একটা রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের।  রেস্টুরেন্টের মালিক নিজেও একজন বাংলাদেশি। 

গান-কবিতা'সহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন চলছে। 

হিমাংকের নিচে তাপমাত্রা'কে জয় করে আমি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছি। যেহেতু সব সময়'ই ব্যাক বেঞ্চার ছিলাম, তাই একদম পেছনের দিকে একটা জায়গা করে নিজের মতো করে বসে আছি। এমন সময় দুটো ছেলে সামনে থেকে উঠে এসে বলছে, -স্যার, আপনার কি কিছু ছবি দেখার সময় হবে? কেন না! নিশ্চয়। 

ছেলে দুটো বেশ আগ্রহ সহকারে ছবি গুলো দেখাচ্ছে আর বর্ণনা করছে। ওরা বর্ণনা করছে আর আমি খেয়াল করছিলাম ওদের'কে। কতো হবে বয়েস- ২০-২২ কিংবা ২৫ এর মতো। উত্তর-পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট দেশ এস্তনিয়া'তে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসছে বাবা-মা, প্রিয়জন ছেড়ে হাজার মাইল দূরে। 

এমন সময় পাশে বসে থাকা ছেলেটা বলছে, -স্যার, এই ছবিটা দেশের নারায়ণগঞ্জের একটা গানের জলসায় তোলা? বাহ, বেশ তো। স্যার, আমরা একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী'র আয়োজন করেছি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপনি আসবেন আশা করছি। 

আমি কোন কিছু না ভেবে'ই সঙ্গে সঙ্গে বলছি, নিশ্চয় যাবো।  

সেই সন্ধ্যাতে'ই ওদের সঙ্গে হাজির হলাম ইউনিভার্সিটি'তে। পরের দিন থেকে প্রদর্শনী। তাই প্রস্তুতি'র একটা ব্যাপার আছে। ওদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য'ই যাওয়া। 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর ভাবছি- ছেলেপেলে গুলো কি পরম মমতায় ছবি গুলো টানানোর চেষ্টা করছে। নিজ দেশ'কে অন্য দেশের মানুষ গুলো'র কাছে তুলে ধরার কি আপ্রাণ চেষ্টা। 

হঠাৎ করে মনে হলো, দেশে এই বয়সী কতো ছেলে-পেলেদের আমি দেখেছি- দেশ, দেশের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কোন রকম আগ্রহ নেই। অনেক ছেলে-পেলে'কে দেখেছি- দেশের কোন জাতীয় দিবস বা এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাতে'ও তেমন কোন আগ্রহ নেই। 

অথচ এক'ই বয়েসের এই ছেলে গুলো হাজার মাইল দূরে এসে কি পরম মমতায়'ই না বিদেশের মাটিতে দেশ'কে তুলে ধরার চেষ্টা করছে নিজেদের তোলা ছবি'র মাধ্যমে। 

কোন ছবি হয়ত বট গাছের নিচে গানের জলসার কথা বলছে, কোন'টা হয়ত পড়ন্ত বিকেল কিংবা ক্লান্ত দুপুরের গল্প; আবার কোন ছবি হয়ত ইট-কাঠে ঢাকা শহরের প্রতিচ্ছবি। 

যেই ছেলে-পেলে গুলো এই আয়োজন করছে, এদের একজন এসে বলছে, স্যার ছবি গুলো আমরা হয়ত তুলেছি, তবে শেষমেশ সিলেক্ট কিন্তু করে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফি ক্লাব। 

অন্য এক ছেলে বেশ চমৎকার ছবি তুলে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, তুমি তো বেশ ভালো ছবি তুলো ছেলেটা মনে হলো খানিক সঙ্কোচের সঙ্গে'ই বলছে, না স্যার, আসলে আমাকে পুরো কৃতিত্ব দেয়া ঠিক হবে না। দেশে থাকতে আমি এবং আমার দুই বন্ধু মিলে জেমস লাইট ফটোগ্রাফি নামে একটা ক্লাব করেছিলাম। সেখান থেকে'ই অনেক কিছু শিখেছি। ওদেরও এতে অবদান আছে। 

আমি ভাবছিলাম- কি চমৎকার ব্যাপার। অন্যদের কৃতিত্ব দিতে এরা ভুলছে না। 

অথচ কতো জায়গা'ই না দেখেছি একজনের কাজ, অন্য একজন নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে পুরো কৃতিত্ব নিয়ে নিচ্ছে। 

এই ২০-২৫ বছরের ছেলে-পেলে গুলো, যারা এই প্রজন্মের'ই মানুষ। এদের মাঝেও নিশ্চয় নানা মত আছে, আছে নানান আদর্শিক ভিন্ন'তা। অথচ এরা সবাই এক হয়ে- কি পরম মমতায়'ই না নিজ দেশ'কে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। 

নিজেরা এর কোন কৃতিত্বও নিতে চাইছে না। স্রেফ নিজের দেশ'কে চমৎকার ভাবে তুলে ধরার মাঝে'ই মনে হচ্ছে এদের যত আনন্দ। 

আমি যখন ওদের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকে বের হয়ে নিজ বাসায় ফিরছি, তখন অঝর ধারায় তুষার পড়ছে। রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা। শ্বেতশুভ্র তুষারে পুরো রাস্তা ঢেকে গিয়েছে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন এসে ভর করেছে, আচ্ছা, দেশে থাকতে কি আমাদের সবার মাঝে এতো'তা দেশপ্রেম কাজ করত? এরপর হঠাৎ মনে হলো, একটা পরিবারে যখন বাবা-মা, সন্তান এক সঙ্গে থাকে; তখন হয়ত সন্তানরা তাদের বাবা-মা'র মূল্য'টা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। পরিবার থেকে বের হয়ে যখন বাবা-মা'কে ছেড়ে থাকতে হয় কিংবা বাবা-মা যখন আর থাকে না; তখন বোধকরি প্রবল ভাবে বুঝা যায়, তাদের শূন্যতা। 

নিজ দেশও তো আমার মা। দেশে থাকতে হয়ত দেশের প্রতি সেই ভালবাসাটা এতো'টা প্রকট হয় না কিংবা বুঝা যায় না, যতটা দেশের বাইরে গেলে অনুভব করা যায়।  

তুষার পড়ার গতি বাড়ছে, জনমানব'হীন ফাঁকা রাস্তা শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢেকে গিয়েছে। কি মায়াবী একটা পরিবেশ। আমি দ্রুত পায়ে আমার এপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, আহা, আমাদের দেশ এবং পুরো পৃথিবী'র মানুষ গুলো যদি আশপাশের প্রকৃতির মতো এমন ভালোবাসাময় মায়াবী হতো। যেখানে নানা মতের মানুষ থাকবে। আমরা সবাইকে যে যার মত করে নিজেদের মতামত প্রকাশ করবো, দর্শন ধারণ করবো। কেউ কাউকে ছোট করবো না এবং নিজ দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে যাবো।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

 

সর্বশেষ খবর