১৬ মার্চ, ২০১৯ ০৯:৫৫

এরপরও এরাই নাকি শান্তিপ্রিয় মানুষ!

আমিনুল ইসলাম

এরপরও এরাই নাকি শান্তিপ্রিয় মানুষ!

আমিনুল ইসলাম

ফিরছিলাম গ্রিস থেকে। এয়ারপোর্টে আমার সহকর্মী, ছাত্রসহ সবাই পার হয়ে গেল। কেবল আমি গেলাম আঁটকে! ওরা আমার পাসপোর্ট দেখে বলল, ভালো করে চেক করতে হবে। আমি বেশ একটা হাসি দিয়ে বললা, নিশ্চয়। 

এরপর ওরা আমার পাসপোর্ট এই মেশিন দিয়ে চেক করে, ওই মেশিন দিয়ে চেক করে; এরপর আরও কতো কি! এরপর আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি এখানে এসেছো কেন? 
-সামার স্কুলে যোগ দিতে। 
-কিসের স্কুল? 
-শরণার্থীদের উপর একটা সামার স্কুলে। 

এরপর ওরা কাগজপত্র দেখতে চাইল। দেখালাম। খানিক বাদে হেসে বলল, আমাদের এখানে অনেক শরণার্থী থাকে। ওরা মাঝে মাঝে নকল পাসপোর্ট করে ইউরোপের অন্য দেশে পালিয়ে যায়। এই জন্য এভাবে চেক করলাম। 

আমি কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে প্লেনে উঠলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমার সহকর্মী, ছাত্ররা আমার দিকে কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে। ভাবখানা এমন- আমি নিশ্চয় সন্ত্রাসী টাইপ কিছু! যেহেতু ওরা আর কাউকে চেক করেনি, স্রেফ আমাকেই করেছে।!

করবে না কেন! সেখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে আমার মতো ছিল না। সবাই ছিল সাদা চামড়ার! তাই তারা আমাকেই আটকিয়েছে! 

আমার এক মাস্টার্সের ছাত্র থিসিস করছে আমার সুপারভিশনে। সে এই মুহূর্তে ডাটা কালেকশন করছে। ইন্টারভিউ করছে ফরেন স্টুডেন্টদের। কারণ, সে তার মাস্টার্স থিসিসে দেখার চেষ্টা করছে- ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা বিদেশে এসে কেমন অনুভব করছে। কাল রাতে'ই আমার এই ছাত্র ওর ইন্টারভিউয়ের কয়েকটা অডিও টেপ পাঠিয়েছে আমাকে। আমি সবগুলো ইন্টারভিউ শুনতে পারিনি। কেবল এক আফ্রিকান ছাত্রের ইন্টারভিউ শুনেছি। 

সেই আফ্রিকান ছাত্র বলছে, এই দেশে আসার পর আমি প্রতিনিয়ত বর্ণবাদের শিকার হচ্ছি। আমি যে "কালো" সেটা আমি প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি চলতে ফিরতে। 

গত বছর সাউথ আফ্রিকা থেকে এক ছেলে পড়তে এসছিল আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। সেই ছেলে গেল সিটি সেন্টারে। বোধ করি এক রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলো। হঠাৎ এই দেশের সাদা চামড়ার এক লোক তার উপর হামলে পড়ে ছুরি নিয়ে। সেই লোক নাকি বলছিল, কালো মানুষ এই দেশে কি করে! ফিরে যাও নিজের দেশে। 

ছেলেটা পায়ে ছুরির বেশ কয়েকটা আঘাত পেয়েছিল। আমি তাকে হোস্টেলে দেখতে গিয়েছিলাম। ছেলেটা দুঃখ করে বলছিল, পুলিশকে গিয়ে বললাম। ওদের দেখে মনে হলো- অন্যায় মনে হয় আমিই করেছি। 

এর কয়েকদিন পর এই ছেলে পড়াশুনা না করে নিজ দেশে চলে গিয়েছে। আমি যে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, পরবর্তীতে অনুভব করলাম সেটাও অনেকে পছন্দ করছে না। বুঝতে পারলাম, আমিও তো মাইগ্রেন্ট। দেখতে অন্য রকম। 

নিউজিল্যান্ডে আজ এক সাদা চামড়ার এক সন্ত্রাসী মসজিদে ঢুকে ৫০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। এই মানুষগুলোর মাঝে অনেক শরণার্থীও ছিল। যারা নিজ দেশে বাঁচতে না পেরে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু তারা কি আর জানতো ভদ্রবেশী সভ্য সাদা চামড়ার মানুষরা ক্ষেত্র বিশেষে তার দেশের সন্ত্রাসীদের চাইতেও অমানুষ। 

আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি, পুরো পৃথিবী শাসন করছে যেই দেশ, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট কিন্তু মুসলিম আর ইমিগ্রেন্ট বিদ্বেষী কথা বলেই প্রেসিডেন্ট হয়েছে। সে এক সময় বলেছিল, আমেরিকা থেকে সব মুসলিমকে বের করে দিবে। আমেরিকানরা কিন্তু তাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। 

যাদের আপনারা সভ্য বলেন। সেই সভ্য মানুষরা কেবল উপর দিয়েই সভ্য। আমরা যারা প্রবাসী হিসেবে বিদেশে থাকি, আমরা অনুভব করি- কতোটা সভ্য এই মানুষগুলো। 

অন্যদের কথা বলতে পারব না। আমি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি- আমি দেখতে অন্যদের চাইতে আলাদা, আমার ধর্ম আলাদা, আমার সংস্কৃতি আলাদা, সুতরাং আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে ফেলা যায়। আমার কাজ সয়ে যাওয়া। 

এরা মানুষ হত্যা করলে কিছু যায় আসে না। এরা আফগানিস্তানে গিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করলে কিছু হয় না। সিরিয়া গিয়ে পুরো দেশটা ধ্বংস করে ফেললে কিছুই হয় না। মসজিদে ঢুকে পাখির মত গুলি করে মারলেও কিছুই হয় না। পুরো পৃথিবী জুড়ে সতর্কতা জারি করা হয় না। হয় না কোন ভ্রমণের সতর্কতা। 

আমাদের খেলোয়াড়রা বিনা নিরাপত্তায় প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালালেও কিছু হয় না। যত সমস্যা সব আমাদের। গাছের একটা পাতা পড়লেও তাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে - কেন পড়লো পাতা! আর হবেই না বা কেন? আমরা তো সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে- হুজুর হুজুর করতে থাকি। 

আমরা ভুলতে বসেছি- পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মিশর থেকে উঠে এসছে। সেই আমরাই কিনা এখন হয়ে গেলাম অসভ্য আর মানুষ হত্যা করে এবং ইমিগ্রেন্ট আর মুসলিমদের অমানুষ হিসেবে প্রচার করে এরা হয়ে যাচ্ছে সভ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। 

ভুলে গেলে চলবে না প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমাদের মত দেখতে কেউ শুরু করেনি। শুরু করেছে সাদা চামড়ার মানুষগুলোই। পারমাণবিক বোমাও কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষরাই প্রথম মেরে মানুষ হত্যা করেছে। 

আমরা তৈরি করলাম সভ্যতা। আর এই সাদা চামড়ার মানুষরা তৈরি করল কিভাবে সেই সভ্যতা ধ্বংস করা যায়। এরপরও এরাই নাকি শান্তি প্রিয় মানুষ!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/১৬ মার্চ, ২০১৯/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর