৯ জুলাই, ২০১৭ ১৪:০১

ওসিমা ক্যাম্প জো থেকে ছাগামি হারা লেকে একদিন

পি.আর. প্ল্যাসিড:

ওসিমা ক্যাম্প জো থেকে ছাগামি হারা লেকে একদিন

দিনটি ছিল ২ জুলাই ২০১৭, রবিবার। সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের যাবার কথা ওসিমা ক্যাম্প জো-তে। বের হওয়া হলো দশটার পর। আমাদের বাড়ি থেকে কাছের রেল স্টেশনের নাম নিশি উরাওয়া। ট্রেনে গিয়ে নামার কথা বান্দা স্টেশন। ট্রেন লাইনের ম্যাপ দেখে জেনে নিলাম এর মধ্যে ট্রেন বদলানো হবে তিনবার। ট্রেনে চড়লাম ঠিক সকাল পৌনে এগারটার সময়। ট্রেন যাত্রা শুরু করলো আমাদের নিয়ে। ট্রেন লাইনের নাম মুছাশিনো লাইন। 

প্রথম গিয়ে পৌঁছলাম নিশি কুকোবুনজি স্টেশন। সেখান থেকে চ্যুয়ো লাইনে হাচিওজি স্টেশন। সাথে আমার ছেলে থাইও প্ল্যাসিড আর তার মা ইউকী খামিজো। এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে যাবার সময় আমার হাটায় ঢিলেমি থাকলেও ওরা আমাকে রেখে আগে যাবার চেষ্টা করে না। ওরা খুব ভালো করেই জানে আমার শরীর যে দৌড়ে চলার উপযোগী নয়। 

প্ল্যাটফরম বদলে গিয়ে উঠলাম ইয়োকোহামা লাইনে। কয়েক স্টেশন পরেই হাসিমতো স্টেশন। হাসিমতো থেকে আবার কেইহিন ছাগামি হারা লাইনের ট্রেনে চড়লাম। এখানে ট্রেন ব্যবস্থা টোকিও থেকে ভিন্ন। স্টেশনে থামানো ট্রেনের সব দরজা খোলা থাকে না। যে যার মতন দরজার পাশে লাগানো বাটন টিপে দরজা খুলে তারপর ভিতরে গিয়ে বসে। আমরাও তাই করলাম। গ্রাম এলাকায় এখনো পুরোনো দিনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যদিও জাপানের সব এলাকাতেই আধুনিকতার ছাপ রয়েছে তারপরেও কোথাও কোথাও লোক সংখার কারণে আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় মাতেনি। তারই কিছুটা প্রমাণ এই ট্রেন। সময় মতন ট্রেন ছাড়লো। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য বান্দা স্টেশনে। বাজে তখন এগারোটা পঞ্চাশ। সেখানে গিয়ে দেখি পুরোনো দিনের ব্যবস্থা।

পুরো স্টেশন ফাঁকা। হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী নামলো সেখানে। বলা যায়, পুরো ট্রেনই ছিল ফাঁকা। স্টেশনের ভিতরে দাঁড়িয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করলাম আমাদের আমন্ত্রণকারী সহিদুল হক এর জন্য। ভিতরের অস্থিরতা কাটাতে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে গিয়ে দেখি গ্রামের চিত্র আশেপাশে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম সহিদ ভাই দেরি করার তো লোক নয়। দেরি করছেন কেন? মিনিট দশের মধ্যেই সহিদুল হক চলে আসলেন। আমি দূর থেকেই তার গাড়ি দেখে চিনেছি। আমাকে দেখে সহিদ হাসছিলেন আর হাত নেড়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। 

গাড়ি থামতেই আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। জানি, তার গাড়ির ভিতর যে সবসময় অগোছানো থাকে। তাই আমাদের তিনজনের বসার স্পেস এবং বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া আমার বই ভর্তি ছোট স্যুটকেসের জায়গা হবে কিনা, দেখছি। এরই মধ্যে সহিদুল হক গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে রাখা তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে পিছনের ছিটে বসার ব্যবস্থা করলেন। সামনে আমি বসে পায়ের সাথে কোন রকম কষ্ট হলেও বইয়ের স্যুটকেস রাখলাম। থাইও আর তার মা ইউকী উঠে বসলে সহিদুল হক গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। শহরের পথ হলেও আমাদের দেশে ঈদের সময়কার ঢাকা শহরের রাস্তার মতন ফাঁকা পুরোটা। গাড়ি চলছে তো চলছেই। 

একসময় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে গাড়ি পার্কিং করে তিনি আরো কিছু কেনাকাটা করলেন। এরপর আবার যাত্রা শুরু। সমতল রাস্তা থেকে নীচের দিকে ঢালু রাস্তায় গাড়ি চলছে। বুঝতে পারলাম পাহাড় থেকে নামছি। কিন্তু কখন যে পাহাড়ে উঠেছিলাম, তা বুঝতে পারিনি। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি সামনে বিশাল ব্রিজের মতন উড়াল রাস্তা। রাস্তার একদিকে পাহাড়ি ঝড়না। গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে দিলাম। গাড়ির শব্দকে ছাড়িয়ে পানির ঝড়নার কলকল শব্দ কানে লাগছে। বাইরে বইছে ঠান্ডা বাতাস। বড়বড় সবুজ সাকুরা ফুলের গাছের ছায়া ভেদ করে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম ওসিমা ক্যাম্প জো (সাইট) এ। 

গিয়ে দেখি সেখানে আগে থেকেই লোকজন যে যার মতন তাদের কাজ করছে। একটু দূরে দূরে তাবু টানানো। আমার জাপান আসার শুরুর দিকের কথা মনে পড়ে গেল। আমি প্রতি মাসেই শীত বর্ষা গরম সুযোগ পেলেই জাপানিজ বন্ধুদের সাথে দূরে কোথাও চলে যেতাম। সেখানে তাবু টানিয়ে রাত কাটাতাম এবং সকালে নিজেরাই মাছ ধরে তা পুড়িয়ে খেতাম। 

সহিদুল হক ব্যক্তিগত জীবনে একজন পেশাদারী ফটো সাংবাদিক। ছবি তোলার কাজেই সারা জাপান তার ঘোরা। এভাবেই কখনো তাবু টানিয়ে, কখনো গাড়িতে রাত কাটিয়ে সময় পার করেন। গতরাতও এখানে সে তাবু টানিয়ে কাটিয়েছেন বলে জানালেন। তখনো তার তাবু সেখানে টানানো। আমাদের জন্য আগে থেকেই ভ্রাম্যমাণ সব কিছু রেডি ছিল তার তাবুতে। সামনে চেয়ার বসানো। আমি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ওয়েদার ছিল খুবই সুন্দর। ফুরফুরে বাতাস। চারিদিকে সবুজ গাছ-গাছালিতে পাহাড় ঘেরা। পাশেই পাথরে ভরা মরা নদী। যে নদীতে কলকলিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝড়নার পানি সাগরের উদ্দেশ্যে বয়ে চলেছে।

আমার দৃষ্টি সবুজ পাহাড়ের উপর নিয়ে গেল। মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল তখন এই সবুজ দেখে। পাহাড়ের উপর নীল আকাশ, নীচে কলকলিয়ে ধেয়ে যাওয়া নদীর পরিস্কার পানি। এসব আমার চোখকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আশে পাশে অনেক সুন্দরী জাপানিজ মেয়ের সমাগম দেখেও চোখ যায়নি ওদের দিকে। প্রকৃতিই আমায় টানছিল বারবার। আমরা যাবার একটু পরেই বিভিন্ন দেশের প্রবাসী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ এসে যোগ হলেন আমাদের সাথে। এদের মধ্যে ইরান, ইন্ডিয়া, মরিশাস, পাকিস্তান, জাপান ও বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। আগত সবাই এখানে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। সবাই সহিদুল হকের পূর্ব পরিচিত।

থাইও দৌড়ে দৌড়ে তার মার কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করেছে। সামনে শুরু হয়েছে বাচ্চাদের চোখ বেধে তরমুজ ভাংগার খেলা। আমি চলে গেলাম বাচ্চাদের খেলায় উৎসাহিত করতে। থাইও আমার মতন সবার সাথে মিশুক হলেও এখানে এসে অনেকটা তার মায়ের সাথে থেকে মাছ পোড়ার কাজে সহযোগিতা করছে বিধায় সামনে খেলাধুলা চলতে থাকলেও সেখানে সে যায়নি। থেকে থেকে থাইওকে বলছিলাম আমাদের ছবি তুলতে। আমি ফেইসবুকে লাইভ করছিলাম। পাহাড়ি এলাকা বিধায় নেট খুব ভালো ছিল না। তারপরেও চেষ্টা করেছি কিছুটা হলেও সেখান থেকে (সরাসরি) লাইভ সম্প্রচার করতে। 

মাছ পোড়ানোর শেষ নেই। খাবারেরও শেষ নেই। আমাদের সাথে যোগ দিতে আসা বিভিন্ন দেশের লোকগুলো খেয়ে যে যার মতন চলে গেলো। আমরা সেখানে পেট পুরে খাবার খেয়ে ঝড়নার পানিতে নেমে ছবি তুলছিলাম। তখনো অনেক বেলা বাকী রয়েছে। ভাবলাম এতকাল পর পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হলাম সময়টা অন্য কোথাও গিয়ে উপভোগ করি। তাই পানিতে নেমে আনন্দ করতে করতে সহিদুল হককে বললাম, চলেন এবার অন্য কোথাও যাই ঘুরতে। হাতে সময় যেহেতু আছে, পুরো এলাকা ঘুরে দেখি। 

সহিদুল এ ব্যাপারে এমনিতেই নাচুনে বুড়ি, তার মধ্যে দিলাম ঢোলে বাড়ি। সে ড্রাইভ করতে খুব পছন্দ করে। সাথে সাথে রাজী হয়ে বললেন, তাহলে সব কিছু গুছিয়ে নেই। চলেন যাই। পাশেই আধা ঘণ্টা সময় লাগবে যেতে। ওখানেও খুব সুন্দর লেক আছে। জায়গার নাম ছাগামি কো। সহিদুল হক বললেন, পাহাড়ের উপরে বিশাল বড় লেক। খুব নামকরা। পাহাড়ের উপর পানি। সেখানে বেড়ানোর জন্য নৌকা সহ আরো অনেক কিছুই আছে। আমি জানি পাহাড়ের উপর বড় লেক গুলোর কথা। সবখানেই প্রায় একই রকম। এসব লেককে জাপানের ভ্রমণ বিলাসী কিংবা বিদেশী পর্যটকদের জাপানের প্রতি আরো বেশী আকৃষ্ট করতেই সূদুর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী করা হয়।

যেই কথা সেই কাজ। সব কিছু গুছিয়ে গাড়ি নিয়ে দিলাম রওনা। রওনা দিয়েই আবার ভাবলাম পাশে দেখার মত পুরাতন একটি ঘর আছে সেটি দেখে না গেলে কেমন হয়? তাই দেখে নিলাম। বিশাল বড় বাউন্ডারীর মধ্যে সেই ঘর। সামনে কয়েকজন বয়স্ক লোক ছিলেন দাঁড়ানো, তারা এই ঘর সম্পর্কে বর্ণনা করছেন দর্শনার্থীদের। সব দর্শনার্থীদের জন্যই ফ্রি। স্থানীয় ওয়ার্ড অফিস এটার রক্ষণাবেক্ষণ করে। প্রতি শুক্রবার এবং রবিবার এখানে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আসে গ্রুপ নিয়ে। কাছেই এক বয়স্কা মহিলা আছেন উনি ছাত্র-ছাত্রীদের এই ঘর এবং অন্যান্য বিষয় বর্ণনা করেন। 

ঘরটির এখন বয়স প্রায় শোয়া তিনশ’ বছর। পুরোটা আমাদের দেশের গ্রামে পুরোনো দিনের ছনের তৈরী চালার ঘরের মত। ভিতরে পুরোটা ঘর  কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। মেঝেটা জাপানিজ তাতামি (ছন জাতীয় ঘাষের) বা মেট্রেসে ঢাকা। একদিকে রয়েছে বিশাল বড় লোহার চুলা। কয়লা দিয়ে এই চুলায় ধোঁয়া তৈরী করে ঘরের ভিতর দেওয়া হয়, যেন কোন ধরনের পোকা মাকড় ঘরের ভিতর আনাচে কানাচে বাসা না বাধে। আরো এক যায়গাতে ভিন্ন রকমের ব্যবস্থা করা রয়েছে, যেখানে নদীতে মাছ ধরে এনে পুড়িয়ে খাওয়া হয়। এসবই প্রতি সপ্তাহে দুইদিন সচল রাখা হয় ছাত্র-ছাত্রী এবং দর্শনার্থীদের জন্য। ঘরের সামনে অনেকগুলো বড় বাঁশ কেটে এনে বাকা করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। পাশেই রঙিন ছোট ছোট কাগজ কেটে সূতা দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। দর্শণার্থীরা এই কাগজে তাদের ভালোবাসার কথা, মনের আশা পূরণের কথা এমনই অনেক কিছু লিখে মানত দেওয়ার মতন করে লিখে বাঁশের সাথে বেধে রেখে যায়। 
ঘরটি দেখে সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।

গাড়ি চলতে শুরু করলো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে বাতাস কেটে আমাদের গাড়ি চলতে লাগলো। আশে পাশে সবুজ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। থেকে থেকে খোলা আকাশের নিচে চলে আসলে আকাশ দেখার সুযোগ পাই। সহিদুলকে বললাম, কয়েক মিনিট ঘুমিয়ে নেই। বলেই চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে গেলাম। একসময় ইউকি আমাকে ডেকে তুলল। চেয়ে দেখি পানির কিনারায় আমাদের গাড়ি পার্কিং করা। বুঝতে পারলাম আমরা পৌঁছে গেছি বিখ্যাত সেই ছাগামি কো লেকে। ওসিমা ক্যাম্প থেকে ছাগামি কো লেক পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে মাত্র আধা ঘণ্টা। সেখানে গিয়ে পুরো এলাকা ঘুরে দেখলাম। পুরো বলতে যেখান থেকে বোট বা বিভিন্ন ডিজাইন করে নৌকা ভিড়ানো রয়েছে সেখানে। ঘাটে রয়েছে বিভিন্ন খাবারের দোকান, আনন্দ করার পরিবেশ এবং কারো জন্য স্যুভিনর কিনে নেবার দোকান। সামনে হাটা-হাটি করে কফির নেশা পূরণ করতে কফি কিনে নিলাম। 

টোকিও থেকে এর দূরত্ব ৬০ কি.মি. এবং পোর্ট সিটি ইয়োকোহামা থেকে ৫০ কি.মি.। ট্রেনে টোকিও থেকে আসতে সময় লাগে এক ঘন্টা। অনেকটা আর্টিফিসিয়ালভাবে তৈরী করা হয়েছে এর চারিপাশের পরিবেশ। সব মৌসুমেই ভ্রমণ বিলাসীদের আকৃষ্ট করার মতন করে গাছ লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন মৌসুমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বদলায়। রাস্তার ধারে সারিবদ্ধভাবে সাকুরা (চেরী ফুলের) গাছ লাগানো হয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে চেরী ফুল ফুটে এর এক রকম সৌন্দর্য ছড়ায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় গাছের পাতার রং বদলে হয় লাল, হলুদ ও সবুজ।

ছেলে-মেয়েরা এখানে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য এবং মাছ ধরতে আসে। কখনো কখনো পুরো লেকের পানিতে নীল আকাশ নেমে আসার মত রঙ দেখায়। বছর জুড়ে এখানে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। স্থানীয় এক বৃদ্ধার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এবছর বৃষ্টি কম হওয়াতে লেকের পানি দুই মিটার কমে গেছে। এটা নিয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ চিন্তিত। মাছের কি হবে? কি হবে নৌকায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের? হেঁটেই ঘুরে বেড়ালাম সেখানে।

সূর্য তখনো তীব্র উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। পানির কাছে গিয়ে বোটগুলো দেখছি আর থাইওকে বলছি ছবি তুলতে। একসময় ছবি তোলার প্রতি তার বেশ আগ্রহ ছিল। ভালো ছবিও তুলতো। আজকাল কেমন যেন দায় সাড়া ছবি তোলে সে। কিছু পৌজ বলে তাকে দিয়ে তোলালাম ছবি। বড় এবং বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট হলেও লোকজন তখন কম ছিল। পানিতে আকাশ দেখা যায় না। চারিদিকের সবুজ পাহাড়ের সবুজ রংই দেখাচ্ছিল লেকের পানিতে। তার মধ্যে ছোট বড় বেশ কিছু রাজহাঁস আকৃতির বোট নিয়ে পর্যটকরা পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদেরও সখ হলো ঘুরে বেড়ানোর। সাড়াদিনের জন্য মাত্র সাড়ে তিন হাজার ইয়েন দিয়ে বোট ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় সেখানে। 

বোট যেখান থেকে ছাড়ে বা ভিড়ে সেখানে একটা ছোট দোকান বারের মতন করে সাজানো রয়েছে। সেখানে কিছু চিপস, বিয়ার, জুস আরো কিছু খাবার সাজানো। বোটে চড়ার যেমন সখ হলো, তেমনই সখ জাগলো মনে বিয়ার খেতে। সেটা প্রকাশ আর করিনি। কারণ সেখান থেকে ফিরে যাবার সময় বাংলাদেশি পরিচিত বন্ধুদের সাথে দেখা করতে ছাগামিহারা মসজিদে যেতে হবে। এই জন্যই সংযম করলাম বিয়ার খাওয়ার ইচ্ছাকে। ফোন এল সহিদুলের পরিচিত কোন এক কোম্পানীর মালিকের কাছ থেকে। বললেন, চলেন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই। একটু পরেই সবাই মসজিদে আসবে। দুপুরের অনেক কিছু বেশী হয়েছে। সেগুলি নিয়ে মসজিদের ফ্রিজে রেখে আসার কথাও বললেন সহিদুল। বলেই গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। সহিদুল গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। কিছুদূর যেতেই দেখি সূর্য পাহাড় পর্বত ভেদ করে আমাদের দিকে আলো ছড়াচ্ছে। তখন বাজে মাত্র সোয়া ছয়টা। তাকিয়ে দেখি স্বাভাবিকের চেয়ে সূর্যকে অনেক বড় দেখাচ্ছে। বললামও তাই সবাইকে। আজকের সূর্যটাকে যে অস্বাভাবিক বড় দেখাচ্ছে। ভর দুপুরের মতন আলো এবং উত্তাপ দুইই যেন ছড়াচ্ছিল। সন্ধ্যা হতে তখনো প্রায় এক ঘন্টা সময় বাকি। 

আমরা চলে গেলাম ছাগামিহারা মসজিদে। মসজিদে তখন কেউ ছিল না। সহিদুল হক ভিতরে গিয়ে অতিরিক্ত মাছ এবং সবজি যা ছিল সব ফ্রিজে রেখে আবার আমাদের নিয়ে ছুটে চললেন। সবই যেন খুব কাছাকাছি। মূহূর্তের মাঝে গিয়ে পৌঁছালাম গন্তব্যে। অর্থাৎ বিশ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম আবার সেই দুপুরের জায়গা ওসিমা ক্যাম্প জো-তে। তবে এবার আরো ভিতরে গিয়ে নদী ছুয়ে গাড়ি থামানো হলো। সেখানে যেতেই দেখি গাড়ির শব্দে পানির ধারে বসে মাছ ধরার অপেক্ষমান কিছু সাদা বক উড়ে চলে যায় পাহাড়ের গা ঘেসে বেড়ে উঠা গাছের দিকে। সেখানে গিয়ে গাছের ডালে বসে। আমার কাছে তখন ছোট বেলার আমাদের বাড়ির পাশের প্রিয় বেল্যার বিলের কথাই তখন মনে পড়ে, যেখানে ঘাস কেটেছি, গরু চড়িয়েছি। বাবার সাথে জমিতে কাজ করেছি। এমনকি মাছ ধরেছি। আমরা তখন তিনজন গল্প করছিলাম আর ছবি তুলছিল থাইও। দূরে কিছু ছেলে মেয়ে পটকা এবং আতস বাজি ফুটাচ্ছিল। কেউ কেউ আগুন জেলে কিছু পুড়িয়ে খাচ্ছিল। চারিদিকে ক্রমেই তখন রাতের অন্ধকার নামছিল। 

আবার সহিদুলের ফোন বেজে উঠলো। সে কথা বলে আগের মতন আমাদের তৈরী হতে বললেন। আমরা তৈরী হয়ে গাড়িতে বসলাম। মসজিদে যেতে যেতে নামাজ পাবেনা মনে করে সহিদুল সেখানে আমাদের আবার তাবুতে নিয়ে বসিয়ে রেখে নদীর পানিতে অজু করে নামাজ পড়ে নিলেন। গাড়িতে উঠে সহিদুল অন্ধকারের মধ্যে বন বিড়ালের চোখের মতন আলো জেলে গাড়ি চালিয়ে ছুটলো। একসময় আবার গিয়ে পৌঁছলাম ছাগামিহারা মসজিদে। আমরা যেতে যেতে সেখানে বিশ জনের মতন মানুষ এসে জড়ো হলো। প্রায় সবার মুখে সাদা কালো দাড়ি। প্রথম বোঝার মতন কোন উপায় ছিল না, এরা বাঙালী না পাকিস্তানি। সবার মুখে উর্দু ভাষার খৈ ফুটছিল। অনেকটা সময় পর সনাক্ত করা গেল সেখানে কেউ কেউ বাংলাদেশি আছেন। তাদের সাথে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত থেকে আবার বাসার উদ্দেশে দিলাম রওনা। 

সহিদুল আমাদের তার গাড়িতে করে হাসি মুখে স্টেশন পর্যন্ত এসে নামিয়ে দিলে পাশেই এক জাপানিজ রেস্টুরেন্টে বসে ডিনার সারলাম তিনজনে। দ্রুত ডিনার সেরে টিকেট কেটে স্টেশন ঢুকে পড়লাম। স্ট্রেশন ঢুকে আবার সেই সকালের মতন করে আমরা ট্রেন বদলে বদলে এসে পৌঁছলাম আমাদের স্টেশন নিশি উরাওয়াতে। ট্রেন থেকে নেমেই সহিদুল হককে ফোন করে জানালাম আমাদের নিরাপদে বাসার কাছে এসে পৌঁছার কথা। সহিদুল শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। 

লেখক: জাপান প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক।

 

বিডি প্রতিদিন/৯ জুলাই ২০১৭/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর