বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

যে কোনো দিন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিলের রায়

যে কোনো দিন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিলের রায়

মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ব্যাপারে আপিলের রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করবেন আপিল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৩৯তম দিনের শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম কোনো মামলা আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন। সাজা বাড়াতে সরকার পক্ষ ৩ মার্চ আপিল করে। খালাস চেয়ে পর দিন কাদের মোল্লা আপিল করেন। ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরু হয়।

গতকাল সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে সরকার পক্ষের সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পরে আদালত বলেন, রায়টি অপেক্ষমাণ রাখা হলো। এ সময় সরকার পক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আসামি পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট শিশির মুহাম্মদ মনির। এর আগে সোমবার অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য গ্রহণ শেষ হয়। এ মামলায় সাতজন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ করেন আদালত।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপিলে সমান সুযোগ দিয়ে আনা সংশোধনীকে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে অকার্যকর বলেছে আসামি পক্ষ। তারা বলছে, এতে আসামির অধিকার খর্ব করা হয়েছে। জবাবে আমরা বলেছি, এতে আসামির অধিকার খর্ব করা হয়নি। এটা সমতা আনার জন্য করা হয়েছে। এতে আসামির সংক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, এ আইনের বিষয়ে সংবিধানে প্রটেকশন দেওয়া আছে। এটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। চ্যালেঞ্জযোগ্য নয়। প্রথাগত আইনের ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের আইনই প্রযোজ্য হবে। আন্তর্জাতিক আইন এখানে প্রযোজ্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। আর কেন দেননি তার ব্যাখ্যাও রায়ে বলা হয়নি। সুতরাং আমাদের আপিল মঞ্জুর হওয়া উচিত।

আপিল শুনানি : কাদের মোল্লার আপিলের শুনানিতে মোট ৩৯ কার্যদিবস লেগেছে। প্রথমে সরকার পক্ষ ও পরে আসামি পক্ষের করা আপিলের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১ থেকে ২৯ এপ্রিল, ৬ থেকে ২০ জুন এবং গতকাল পর্যন্ত মোট ১৫ কার্যদিবসে সরকার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। অন্যদিকে ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ জুন এবং গত সোমবার পর্যন্ত ১৯ কার্যদিবসে আসামি পক্ষে শুনানি করেন কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এ ছাড়া সাতজন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। সরকার পক্ষে শুনানিতে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তার সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা, ট্রাইব্যুনালের রায় পাঠ, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধনী বিষয়ে বক্তব্য এবং আসামি পক্ষের যুক্তির জবাব দেওয়া হয়। অন্যদিকে আসামি পক্ষ কাদের মোল্লাকে খালাস দেওয়ার পক্ষে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন এবং সরকার পক্ষের যুক্তির জবাব দেয়।

এর আগে ১০ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের বেঞ্চ শুনানির জন্য ৩১ মার্চ দিন ধার্য করেন। তবে ওইদিন আপিল বিভাগের নতুন বিচারপতিদের শপথ গ্রহণ ও সংবর্ধনার জন্য এ মামলার শুনানি ১ এপ্রিল শুরু হয়। পরে একজন বিচারপতি অবসরে চলে যাওয়ায় পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন।

অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত : আপিল শুনানিতে দুটি আইনগত প্রশ্ন দেখা দেয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল (প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন)-এর আওতায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ মামলা পড়বে কি না এবং দ্বিতীয়টি হলো আপিলের সমান সুযোগ রেখে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ যে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে তার যে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেওয়া হয়েছে, তা এ মামলায় প্রযোজ্য কি না? এ বিষয়ে আদালতকে সহায়তা করতে গত ২০ জুন সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিযুক্ত করেন আপিল বিভাগ।

অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে এ সংশোধনী আবদুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মতামত দিয়েছেন পাঁচ জন। তারা হলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। অন্য দুই অ্যামিকাস কিউরি টি এইচ খান ও এ এফ হাসান আরিফ মনে করেন এটি প্রযোজ্য হবে না। অন্যদিকে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল লর আওতায় এ মামলা পড়বে বলে তিনজন, পড়বে না বলে দুজন এবং অন্য দুজন ভিন্ন ধরনের মত দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের মতে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও এ এফ হাসান আরিফের মতে, প্রযোজ্য হবে। আর ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির মতে, প্রযোজ্য হবে যদি তা দেশীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দেশীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এটি প্রযোজ্য হবে না। টি এইচ খানের মতেও প্রযোজ্য হবে। তবে তিনি মনে করেন, যে ক্ষেত্রে দেশীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনকে সাংঘর্ষিক বলে মনে হবে, সে ক্ষেত্রে দেশীয় আইন প্রাধান্য পাবে।

শুনানির অপেক্ষায় আরও দুই মামলা : আপিল বিভাগে আরও দুটি মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তা হলো ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ব্যাপারে করা আপিল। সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও আসামি পক্ষ আপিল করেছে। কামারুজ্জামানের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষ আপিল করলেও সরকার পক্ষ করেনি। প্রমাণিত হওয়ার পরেও যেসব অভিযোগে সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল কোনো দণ্ড দেননি সেসব অভিযোগেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সরকার আপিল করে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আশা প্রকাশ করেন, সাঈদীর আপিলের শুনানি প্রথমে শুরু হবে। ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছেন যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল।

'বাবার অপহরণে মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান ছিলেন' : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী, শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক খান। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃতাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গতকাল জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

সাকার পক্ষে সাক্ষী হাজিরের শেষ সুযোগ আজ : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পক্ষে সাফাই সাক্ষী হাজির করতে আসামি পক্ষকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-১ জানিয়েছেন, আজকের মধ্যে সাক্ষী হাজির করতে না পারলে আসামি পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে সাকার সাক্ষী সালমান এফ রহমান বিদেশে আছেন দাবি করে তাকে হাজির করতে সময় চেয়েছে আসামি পক্ষ।

 

 

সর্বশেষ খবর