একজন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বদলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বদলে গেছে হাসপাতালের দৃশ্যপটও। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দলীয় শাসনের আগ্রাসনে আর দুর্নীতি-লোপাটে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেজ শেষ তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ মহাজোট ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের ব্যানারে কেউ কেউ সেই পুরনো কায়দায় দলীয় আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ বাণিজ্য থেকে সর্বত্র খবরদারি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য দেশবরেণ্য চিকিৎসক অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত তা হতে দেননি। মুজিবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন গুরুদায়িত্ব তেমনি তিনিও তা পালনে ষোলআনা সফল হয়েছেন। চারদিকে যখন নেতিবাচক খবর, দুর্নীতি, অনিয়মের মহোৎসব তখন শাহবাগের ঐতিহ্যবাহী এককালের পিজি হাসপাতাল, আজকের বিএসএমএমইউর অহঙ্কারের মাথা উঁচু করে এই নগরীতে দাঁড়িয়ে গেছে অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের নেতৃত্বে। সকাল সাড়ে ৭টায় পুরোহিতের মতো তার কথিত মন্দির কর্মজগৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন উপাচার্য প্রাণ গোপাল। কখনোসখনো গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন অন্যদের উপস্থিতি দেখার জন্য। একেক দিন একেকটি ভবনে ডাক্তার-স্টাফদের হাজিরা ও কার্যক্রম তদারকি করেন। কাউকে অনুপস্থিত পেলেই হাজিরা খাতায় লাল দাগ বসিয়ে দেন। সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতায় তিনি গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টিমওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। চিকিৎসকরা যেমন তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন তেমনি তার নির্লোভ, নিরহঙ্কারী, দক্ষ নেতৃত্বের গুণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ঘুম ভেঙেছে। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দখলবাজদের হাত থেকে উদ্ধার করে ভবন নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন করেছেন। সেখানে গাড়ি পার্কিংসহ ১০টি ব্লক হয়েছে। জায়গার পরিমাণ ১৪ দশমিক ৫ থেকে ১৮ দশমিক ৫৭ একরে উন্নীত করেছেন। কোনো দলবাজি-স্বজনপ্রীতি নয়; মেধা, যোগ্যতা ও আইন, বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দিয়েছেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল। দৃশ্যপট বদলে যাওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আউটডোরে মেডিসিনের দেশসেরা অধ্যাপক এম আবদুল্লাহ থেকে স্বনামধন্য চিকিৎসকরা রোগীদের অনেক দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈকালিক স্পেশালাইজড কনসালটেশন সার্ভিসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। ২০টি বিভাগে এ সার্ভিস চালু করা হয়। অক্টোবর, ২০১১ থেকে জুন, ২০১৩ পর্যন্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৪ জন রোগীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী সেবা পাচ্ছেন। গরিব মানুষ মাত্র ২০০ টাকার টিকিট কেটে এসব ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা পান। এ টিকিটের মেয়াদ এক মাস পর্যন্ত থাকে। এমনকি প্রতি মঙ্গলবার ভিসি প্রাণ গোপাল দত্ত নিজেও বসেন। রোগী দেখেন। আগে বৈকালিক অপারেশন সার্ভিস ছিল না। এখন বৈকালিক অপারেশন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ সার্ভিসে জেনারেল সার্জারিতে ৩৬১ এবং চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগে ৭৪ জন রোগীর সফল অপারেশন হয়েছে। ল্যাবরেটরি সার্ভিস স্থাপনের মাধ্যমে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে প্যাটসিটি সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে অসুস্থ রোগীদের টেলিফোন-মোবাইলে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। প্রাণ গোপাল দত্তের গতিময় নেতৃত্বে হাসপাতালের বেড ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০-তে উন্নীত হয়েছে। আইসিইউর বেড ছিল ১৬টি। এখন ৪৬টি। সিসিইউর বেড ছিল ১৪টি। এখন ৩০টি। ক্যাবিন ছিল ৬৬টি। এখন ১১০টি। সাড়ে ৬ কোটি টাকা মূল্যের একটি সিটিস্কান মেশিন, ৮ কোটি টাকা মূল্যের একটি এমআরআই মেশিন এবং দুটি অত্যাধুনিক এঙ্-রে মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। পরিবহন পুলে গাড়ির সংখ্যা ছিল আগে ১১টি। বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও অনুদান থেকে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়েছে। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য কেনা হয়েছে অত্যাধুনিক দুটি অ্যাম্বুলেন্স। অনেকে বলছেন, উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছিলেন হাসপাতাল তার কাছে মন্দির। তিনি প্রমাণ করেছেন গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোসহ পরিবেশ পাল্টে দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে কোনো নার্সিং কোর্স চালু ছিল না। চার বছর মেয়াদি বিএসসি নার্সিং কোর্সে এখন ৬৬ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। প্রাণ গোপাল দত্ত দায়িত্ব গ্রহণের আগে দেশের কোনো মেডিকেল কলেজ বা ইনস্টিটিউট এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল না। এখন ৩১টি মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউট অধিভুক্ত করা হয়েছে। আগে এমপিএইচ ও এমটিএম কোর্স ছিল না। এখন এক বছর ছয় মাস মেয়াদি এমপিএইচ কোর্স ও দুই বছর মেয়াদি এমটিএম কোর্স প্রবর্তন করা হয়েছে। ছিল না রেসিডেন্সি কোর্স। ২০১০ সেশন থেকে এমডি/এমএস/এমফিল কোর্সগুলো রেসিডেন্সি পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। আগে ডিপ্লোমা কোর্সগুলো এক বছর মেয়াদি ছিল। এখন দুই বছর মেয়াদি। এ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হওয়ায় রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ৫০ জন বিদেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছেন। প্রাণ গোপাল দায়িত্ব গ্রহণের পর ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড গঠন করে এ পর্যন্ত ৩৫১ জন গবেষক ছাত্রছাত্রীর গবেষণা কার্যক্রমের জন্য ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষক, কনসালট্যান্ট, অফিসার, কর্মচারীসহ জনবল ছিল ৩ হাজার ২৮৪ জন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৩৬ জনে। বর্তমানে চারটি বিভাগ বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এন্ড্রোক্রাইনোলজি, রিউমেটোলজি, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিঙ্ ও ডিপার্টমেন্ট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট নার্সিং বিভাগ। বর্তমানে প্রায় ১০টি নতুন উইং প্রবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে পেলিয়াটিভ কেয়ার, সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন, পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি, পেডিয়াট্রিক রিউমাটোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি, রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড এনফার্টিলিটি, ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন, গাইনোকলোজিক্যাল অনকোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি এবং স্তন্য ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যান্সার শনাক্তকরণ কেন্দ্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নাল প্রকাশনা, পরিবর্ধন, পরিমার্জনসহ আরও তথ্যভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এরই মধ্যে তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রেখে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে জানুয়ারি ও জুলাই সেশনে মেধাক্রম অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছে। গত চার সেশনে ভর্তি পরীক্ষায় স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একাডেমিক কাউন্সিল নিয়মিত সভা করছে। নিয়মিত পরীক্ষা ও স্বল্পসময়ে ফল প্রকাশে কর্তৃপক্ষ সক্রিয়। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। হাসপাতালের পরিবেশ এতটাই বদলেছে যে সেই নোংরা, ময়লা-আবর্জনা হাসপাতালের অভ্যন্তরে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায় না। আবর্জনা চলে যাচ্ছে হাসপাতালের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশ থেকে যেমন হকার উচ্ছেদ হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ক্যাম্পাসে অবাধ বিচরণে আনা হয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। এখন সপ্তাহে শুধু দুই দিন এক ঘণ্টা করে চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে বহিরাগতদের দ্বারা অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হতো। এটি উচ্ছেদ করার পাশাপাশি সিন্ডিকেটের চার সদস্যকে পুলিশেও দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে পাঠানো যেমন বন্ধ হয়েছে, তেমনি ক্যাম্পাসের আশপাশে গড়ে ওঠা নেশাখোরদের আস্তানা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে একসময় নেশাখোরদের ঘোরাঘুরি, ফেনসিডিল বহন এমনকি কর্মচারীদের অলস আড্ডা ও তাস পেটানোর দৃশ্য দেখা যেত। এখন আর তা দেখা যায় না। ক্যাম্পাসের ভেতরে চাঁদাবাজি বন্ধ করে চাঁদাবাজ টুন্ডা রহিমসহ ১১ জনকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার করানো হয়েছে। রোগীদের ভোগান্তি দূর করতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্রুত সারতে ওয়ান পয়েন্ট ল্যাবরেটরি সার্ভিস রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অভাবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকাণ্ড ব্যাহত না হয় সে জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি ইলেকট্রিক্যাল সাবস্টেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। রাত্রিকালীন নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ৪০টি পয়েন্টে সার্চলাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তনের এ দৃশ্যপট, দৃশ্যমান উন্নয়নের চালচিত্র উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের মাথায় সাফল্যের মুকুটই পরায়নি, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বকে পথ দেখাতে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিনয়ী এ মানুষটি দিনরাত ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির জন্য। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরেই দাঁড়ায়নি, ইমেজ পুনরুদ্ধারই করেনি, সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।