শিরোনাম
বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

তিন বছরেও 'শুকনো রাস্তায় নৌকা টানা' শেষ হয়নি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নৈশ প্রহরীর কাজ করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। আবার যিনি রেজিস্ট্রারের গাড়ি চালান তিনিও একজন পরিচ্ছতাকর্মী। পিয়ন বা দারোয়ানের কাজেও সেই তারাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ'-প্রায় সব কাজই করেন অস্থায়ী ভিত্তিতে নেওয়া দৈনিক ১২০ টাকা বেতনের ২৩ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এদিকে সোয়া তিন বছরেও আর্কাইভ ও রিসার্স সেল হয়নি প্রসিকিউশনে। তদন্ত সংস্থার আবাসন সংকট কাটেনি। যাত্রার শুরু থেকে এমন সব অপ্রতুলতার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। অথচ এই সোয়া তিন বছরে ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার সাফল্যের পাল্লা ভারি বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে প্রসিকিউশনের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, এটা অনেকটা 'শুকনো রাস্তায় নৌকা টানা'র মতো। তারা বলছেন, শুরু থেকে যথাযথ লজিস্টিক ও অন্যান্য সাপোর্ট পেলে স্বল্প সময়ে সাফল্যের মাত্রা বাড়ত আরও।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন দল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। এর মাঝে একে একে গ্রেফতার হয় মানবতাবিরোধী অপরাধী মামলার আসামিদের। তবে শুরু থেকেই অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যে যাত্রার শুরু তা আজও রয়ে গেছে। বরং তা এখন বোঁঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের সংকট কাটছে না: প্রায় সোয়া তিন বছর আগে সংকট নিয়েই যাত্রা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই সময়কার আনুষঙ্গিক অনেক অপ্রতুলতা রয়েছে এখনো। ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রধান ও চোখে পড়ার মতো সংকট হলো পর্যাপ্ত স্থানের অভাব। তীব্র জায়গা সংকট নিয়েই কাজ করতে হয়েছে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালকে। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকক্ষে অনেকটা ঠাসাঠাসি করে বসতে হয় আইনজীবী ও সংবাদকর্মীদের। পর্যবেক্ষকদের বসার জায়গা নেই বললেই চলে। এসব কারণে রায়ের সময় ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারকক্ষকে ব্যবহার করেন এই ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-২ এর কনিষ্ঠ সদস্যের বেঞ্চ অফিসার নেই। ট্রাইব্যুনালে একটি লাইব্রেরি নেই। পর্যাপ্ত বই-পুস্তক, প্রকাশনা আর পাঠকক্ষ তো নেইই। গ্রন্থাগারিকও নেই। নথিপত্র সংরক্ষণে একটি রেকর্ড রুম থাকলেও নেই কোনো রেকর্ডরক্ষক। স্টাফ পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা নেই। একটি আইটি কক্ষ থাকলেও সেখানে আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালে একজন হিসাবরক্ষক নেই। নেই একজন কোর্ট কিপার ও ক্যাশিয়ার। সিসি ক্যামেরা থাকলেও তা ব্যবস্থাপনার কেউ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুজন সদস্যদের দিয়ে এ কাজটি করানো হয়। ট্রাইব্যুনাল পরিচালনার উপযোগী ও অভিজ্ঞ স্টাফেরও রয়েছে অভাব। সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর ১১৩টি পদের সুপারিশসহ একটি অর্গানোগ্রাম আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ৮১টি পদের অনুমোদন দিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর সেটি পাস হয়। পরবর্তীতে যুক্ত হয় আরও দুটি পদ। সূত্র আরও জানায়, সোয়া তিন বছরেও ট্রাইব্যুনালের জনবল সংকট কাটেনি। দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালির পর গত ডিসেম্বরে অর্গানোগ্রাম পাস হলেও বিধি চূড়ান্ত না হওয়ায় আটকে গেছে নিয়োগপ্রক্রিয়া। এ কারণে দীর্ঘ দিন ধরে হাজিরাভিত্তিক লোক দিয়েই চলছে ট্রাইব্যুনালের কাজ। জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'বিধি চূড়ান্ত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা আশাবাদী যে, এ সরকারের আমলেই নিয়োগবিধি পাওয়া যাবে।'

সীমাবদ্ধতার অভাব নেই প্রসিকিউশনে

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিকালের দিকে কম্পিউটার অপারেটর প্রসিকিউশনে থাকেন না। এ কারণে বিকালের পরে প্রসিকিউটররা কম্পিউটারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন না। ফটোস্ট্যাট মেশিন অকেজো থাকে বেশিরভাগ সময়ই। প্রসিকিউশনে রিসার্স সেল নেই। ১৫ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায়ের আগে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যানও বলেছেন, 'প্রসিকিউশন পর্যাপ্ত সংখ্যক রেফারেন্স বই দিতে পারেনি। এ কারণে প্রয়োজনীয় বই ট্রাইব্যুনালকেই খুঁজে দেখতে হয়েছে। অপেক্ষমাণ রাখার পর রায় ঘোষণায় বিলম্বের এটিও ছিল একটি কারণ।' তাছাড়া প্রসিকিউশনের আর্কাইভ নেই। সংরক্ষণের ব্যবস্থা বা আর্কাইভ না থাকায় প্রসিকিউশনের সদস্যদের কাছে ডকুমেন্টগুলো বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে কম্পিউটারসহ অন্যান্য সাপোর্টিং বিষয়ের জোগান দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখনো অনেক প্রসিকিউটরের সরকারি গাড়ির সুবিধা নেই। প্রসিকিউশনের লজিস্টিক সাপোর্টের কথা বলতে গিয়ে অতীতকে স্মরণ করলেন প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনাল ভবনে প্রসিকিউশনের অফিস থাকার সময় কত কষ্টই না করেছি আমরা। আমাদের বসার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার সাহেব এখন যে কক্ষে বসেন; সেই ছোট কক্ষটিতে গাদাগাদি করে বসতাম সবাই। সেখানে বসে স্বাভাবিকভাবেই কোনো কাজে মনোনিবেশ করা যেত না।' এই প্রসিকিউটর জানান, এখানেও নিত্যনতুন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা নিয়েই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও চিফ প্রসিকিউটরের একজন ব্যক্তিগত সহকারী নেই। এ কারণে দায়িত্ব পালনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। নিজের জন্য একজন ব্যক্তিগত সহকারী চেয়ে সরকারের উচ্চ মহলে আবেদন করতে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুও বিব্রতবোধ করেন বলে জানা গেছে।

তদন্ত সংস্থায়ও সংকট : সংকট মুক্ত নয় তদন্ত সংস্থাও। জনবলের অভাব রয়েছে এখানে। তদন্ত সংস্থার অন্যতম প্রধান সমস্যা আবাসন সংকট। আবাসন সংকটের কারণে তদন্ত সংস্থার কার্যালয় বারবার স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডিতে যেখানে তদন্ত সংস্থার কার্যালয় স্থাপিত রয়েছে, সেখানেও রয়েছে স্থান সংকট। সেখানে স্টাফদের বসার জায়গাও নেই। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, 'নতুন একটি ভবনে তদন্ত সংস্থার কার্যালয় নেওয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে গণপূর্ত বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। সেটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।' তিনি বলেন, 'বারবার স্থান পরিবর্তনের ফলে তদন্ত সংস্থার কাজে বিঘ্ন ঘটে।'

সর্বশেষ খবর