বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া

আশার আলো নিভে যাচ্ছে

সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট সংকট কাটাতে সংলাপের মাধ্যমে যে সমাধানের আশা করা হচ্ছিল, তার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন, দেশে বা বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু দুই নেত্রীই অনড় অবস্থানে থাকায় আশার আলো নিভে যাচ্ছে। সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিশিষ্টজনেরা বলেন, সংকট সমাধানে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সংঘাতবিহীন একটি সমাধানের জন্য প্রধান দুই নেত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে দেশের মানুষকেই।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'সংসদ, মন্ত্রিসভা, এমপি বহাল রেখে কোনোভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। আর বিএনপি আন্দোলন না করেও যদি নির্বাচন বয়কট করে তাহলে ওই নির্বাচন দেশি-বিদেশি কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতিসংঘও বিষয়টি মেনে নেবে না। কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ এমন সিদ্ধান্ত নিলে সমঝোতার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা অনেক আগে থেকেই। সোমবার সচিবদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিদেশি মহলও চিন্তিত। তবে এমনও হতে পারে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আলোচনায় ছেড়ে দিয়েছেন। দেখছেন বিরোধী দল কী ধরনের ভূমিকা পালন করে। কারণ, জানুয়ারি পর্যন্ত যেহেতু সময় আছে তাই সমঝোতার পথ এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি।' বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মাধ্যমে সংলাপ-সমঝোতার সম্ভাবনার পথ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অনিবার্য সংঘাতের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে, এ সংঘাত কতটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে, তা নিয়ে।' তিনি বলেন, 'সংবিধানের ১২৩ (৩)-এর (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনকে নতুন আচরণবিধি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হবে। এ ছাড়া সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাবে। আর সব দল নির্বাচনে অংশ না নিলে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।'
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়াস করিম বলেন, 'আরেক দফায় হতাশ হলাম। দুই দলের বিরোধের কারণে যে সংকট তা সেই তিমিরেই থেকে গেল। সমাধানে অগ্রগতির সম্ভাবনাও কমে এলো।' তিনি বলেন, 'সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারেন না। তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। তবে সংসদ ভাঙা হবে কি হবে না তা নির্ধারণের অধিকার সংবিধান সরকারকে দিয়েছে।' পিয়াস করিমের মতে, 'তিন কারণে নির্বাচন নিয়ে সংকটের সমাধান সরকারকেই করতে হবে। এক. সংবিধান সংশোধন করে সরকারই এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। দুই. বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তাই জনমতের ওপর শ্রদ্ধা রেখে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তিন. তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় সরকার সমস্যার সৃষ্টি করেনি, তবুও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল হিসেবে সরকারকেই সংকট সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে।' দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আগে থেকে যা ধারণা করা হচ্ছিল সেই সংকটময় পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হলো। সুড়ঙ্গের পেছনে যে আলো দেখা যাচ্ছিল তা নিভে যাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'অন্যান্য দেশে সংসদ বহাল রেখে যে নির্বাচন হয়, সে জন্য যে পূর্বশর্ত নিশ্চিত করতে হয় তা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। পরস্পরের প্রতি যে আস্থার প্রয়োজন তা এখানে অনুপস্থিত। তাই সব পক্ষকেই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে একটি সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি সবার মতো গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক রাজনীতিকদেরও বুঝতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক শব্দটা যেহেতু এখন গ্রহণযোগ্য নয়, তাই তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়- এর মাঝামাঝি কোনো একটা সরকার নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যহত হবে।' ইফতেখারুজ্জামানের মতে, '৩০ বা ৪০ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে, তা দেশ-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে আশাবাদী হিসেবে আমরা চাই, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই কাণ্ডারির মানসিক পরিবর্তন হবে। কারণ তাদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতার পরিমাণটা বেশি। জনগণকেও সংঘাতবিহীন সমাধানের জন্য সোচ্চার হতে হবে। দুই নেত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।'
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, সংসদ সদস্যরা সপদে বহাল থাকবেন, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও এমন চর্চা নেই। এই সিদ্ধান্তে যদি সরকার অটল থাকে, আর বিরোধী দল যদি রাজপথমুখী হয়, তাহলে সংঘাত অনিবার্য।'

সর্বশেষ খবর