মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

উল্টো মার্কিন অর্থনীতিই এখন ধরাশায়ী

বাংলাদেশকে জিএসপিবঞ্চিত করার প্রভাব

উল্টো মার্কিন অর্থনীতিই এখন ধরাশায়ী

বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) সুবিধা স্থগিত করার পর এখন উল্টো সংকটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য। অতিরিক্ত করের ফাঁদে পড়ে লোকসানের মুখে পড়ছে আমদানিকারকরা। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কমে গেছে বিক্রি। ফলে দেশটির খুচরা বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক কোম্পানি খরচ কমাতে গিয়ে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে কর্মসংস্থানে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই মন্দা পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী দু দুটি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার রেশ কাটতে না কাটতে জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যে এই নতুন সংকট দেশটিতে মন্দার প্রভাব আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে নিচে ফেলে শীর্ষে আসীন হয়েছে চীন।
‘লস্ট সেলস, ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড জবস : ইমপ্যাক্ট অব জিএসপি এক্সপিরেশন আফটার ওয়ান ইয়ার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরেছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সংগঠন কোয়ালিশন ফর জিএসপি। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে প্রতিবেদনটি গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জের ধরে গত বছরের ২৭ জুন বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক খাতে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কলকারখানার পরিবেশ উন্নত, পরিদর্শনসহ শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে দেশটি জানিয়ে দেয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি দেখাতে পারলে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা হবে। এরপরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত বাস্তবায়নে একযোগে কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার মার্কিন বাণিজ্য দফতরে বেঁধে দেওয়া শর্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হলেও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের কোনো ঘোষণা আসেনি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধার ওপর এখনো স্থগিতাদেশ আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে দেশটির ৪০টি রাজ্যে ব্যবসারত বিভিন্ন কোম্পানির ওপর জরিপ চালিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এই সংকটময় পরিস্থিতি তুলে ধরে গত ১৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
জানা গেছে, কোয়ালিশন ফর জিএসপির জরিপ প্রকাশের পর মার্কিন নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে এমন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যানদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ব্যাপারে। গত ৮ অক্টোবর সংস্থাটি এক টুইটার বার্তায় বলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব জিএসপি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য অন্তত ৬২০টি আমেরিকান কোম্পানি মার্কিন কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়েছে। পরদিন ৯ অক্টোবর সংস্থাটি আরেক টুইটে বলেছে, জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে গত আগস্ট মাসে মার্কিন আমদানিকারকদের ৫৮ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হয়েছে। কংগ্রেসম্যানরা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে বিলম্ব করায় ব্যবসায় ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে। ২০১৪ সালের মধ্যে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে না নিলে এই ব্যয় বেড়ে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রতিবেদনে তার উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা স্থগিতাদেশের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে প্রতিদিন ২ মিলিয়ন ডলার করে অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। এর ফলে স্থগিতাদেশের এক বছরে কর বাবদ ৬৭২ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ৪০টি প্রদেশের বিভিন্ন কোম্পানিকে এক মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ১০০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার কোম্পানি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে বেশিরভাগ কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছোট ছোট কোম্পানিগুলোর। ১০০ বা তার কিছু কম কর্মসংস্থান রয়েছে এমন কোম্পানিগুলোর ৮০ শতাংশই জিএসপি স্থগিতাদেশের ব্যাপারে নিজেদের মতামত দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর জিএসপির প্রভাব নিয়ে এই জরিপ প্রতিবেদনটি এমন একটি সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে যখন প্রথমবারের মতো মার্কিন অর্থনীতিকে অতিক্রম করে চীনের শীর্ষস্থান আসীনের খবরটি জানিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অর্থনীতিও কড়া নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ের ওপর। এশিয়ার অর্থনীতির এই উত্থানের পাশাপাশি পশ্চিমা অর্থনীতির মন্দা নিয়ে এখনো সতর্কতা রয়েছে। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বোর্ডসভায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর বাজেটে ব্যয় যেন না কমানো হয়, কারণ মন্দার প্রভাব এখনো ওই দেশগুলোতে রয়ে গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোর এমন সংকটময় পরিস্থিতি এড়াতে দেশটির সরকার যদি জিএসপি সুবিধা আবারও পুনর্বহাল করে তবে কতটা লাভবান হবে বাংলাদেশ? এমন প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও এফবিসিসিআই-এর উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বলেন, জিএসপি নিয়ে যত সংকটই হোক না কেন মার্কিন সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এ বিষয়টি নেই। দেশটির কংগ্রেস যে ট্রেড পলিসি করেছে তাদের এজেন্ডাতেই নেই এই ইস্যুটি। আফ্রিকান দেশগুলোকে তারা শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই জিএসপি সুবিধা নিয়ে আলোচনা না করে বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা আদায় করা। এটি না করতে পারলে জিএসপি পুনর্বহালেও লাভ হবে না। কারণ তাতে দেশের এক শতাংশের কম পণ্যের ক্ষেত্রে কর সুবিধা পাওয়া যাবে। এর বাইরেই থেকে যাবে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। প্রসঙ্গত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জিএসপির আওতায় বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকলেও বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রয়ে গেছে এর বাইরে। পোশাক খাত ছাড়া বাংলাদেশের যেসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়া যেত তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তামাক, রাবার এবং প্লাস্টিক সামগ্রী, গলফ খেলার উপকরণ, স্লিপিং ব্যাগ, হ্যান্ডলুম ওভেন কটন কার্পেট, ফ্লোর কভারিং ইত্যাদি। অপ্রচলিত এসব পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় থাকলেও দেশের পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত এমএফএন ট্যারিফ ভ্যালুর পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর