নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৫ জন নিহত ও অর্ধশত যাত্রী আহত হয়েছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নাটোর ফায়ার সার্ভিস, হাইওয়ে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের রাজ্জাক মোড়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন একই দিক থেকে আসা একটি ট্রাককে ওভারটেক করার সময় নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী যাত্রীবাহী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের সঙ্গে কেয়ার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। কেয়া পরিবহনের পেছনে প্রাইভেট কার নিয়ে আসা বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন বলেন, বিকট শব্দে বাস দুটির মুখোমুখি সংঘর্ষের পর মহাসড়কের দুই পাশের দুটি গর্তে ছিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রাস্তা ও আশপাশে আহত ও নিহতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকেন। এ সময় আহতদের আর্তচিৎকার ও দুর্ঘটনার শব্দে এলাকার শত শত মানুষ উদ্ধার করতে ছুটে আসেন। খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর ও দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস এবং থানা ও হাইওয়ে পুলিশ এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই গাড়ির চালকসহ ২৮টি লাশ উদ্ধার করে ট্রাকে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি অজ্ঞাত আরও পাঁচজন বিকালে মারা যান। আহতদের নাটোর সদর হাসপাতাল, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বনপাড়ার পাটোয়ারী ক্লিনিক ও আমিনা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মো. আবুল কালাম আজাদের ওপর একই দিন সকালে দুর্বৃত্তদের হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে থাকা এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রশাসনের অনুরোধে তাৎক্ষণিক আহতদের চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসেন।
ঘটনার পরপরই নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান, পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক ও বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ একরামুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতদের মধ্যে তৎক্ষণাৎ কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন (৪০), তার মেয়ে জান্নাতি (৫), একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আলাল উদ্দিন, সংগ্রামপুরের আবদুর রহমানের স্ত্রী আতিকা বেগম, খোকসা গ্রামের কৃষ্ণপদ সরকার (৫৫), ইন্দ্রপাড়া গ্রামের জান মোহাম্মদ (৪৮), গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলী গ্রামের এবাদ আলী (৪৫), শরীফ উদ্দিন (৩০), লাবু (৩৫), আলাল (৫৫), সোহরাব হোসেন, আয়নাল হক (৩৫), সতের আলী প্রামাণিকের দুই ছেলে রব্বেল আলী (৪৫) ও আতাহার আলী (৫০), বৃচাপিলা গ্রামের বাবুল (৪০), আবদুল আওয়াল (৩০), তেলটুপি গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে মোহনা (৫) এবং অথৈ পরিবহনের চালক আলম হোসেন (৪০)। অথৈ পরিবহনের যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগই সিধুলী গ্রামের ডা. ইয়ারুল ও আমিরুল ইসলাম জোড়া খুন মামলায় নাটোর কোর্টে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুর্ঘটনায় অথৈ পরিবহনের বেশির ভাগ যাত্রীই মারা যান। এ ছাড়া সিধুলী গ্রামের হাফিজুর ও ফরিদুল নামে আরও দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান বলেছেন, ঘটনাস্থল থেকে ২২টি লাশ উদ্ধার করে বনপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি ২০ জনের মধ্যে পাঁচজন এবং গুরুদাসপুর হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
তদন্ত কমিটি গঠন : নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বড়াইগ্রামে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মূল্যবান প্রাণহানি ও আহতের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। গতকাল রাতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, ওই দুর্ঘটনা তদন্তে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুজন হলেন নাটোরের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবং বিআরটিএর সহকারী পরিচালক। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার শোক : বড়াইগ্রামে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পৃথক বাণীতে তারা নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর শোক : এদিকে মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানান।

বিভিন্ন স্থানে আরও চারজন নিহত : কাপাসিয়া প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের ঢাকা-কাপাসিয়া-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের রাজাবাড়ী বিদ্যালয়ের সামনে বালিভর্তি ট্রাক উল্টে খাদে পড়ে গতকাল ঘটনাস্থলে শুক্কুর আলী ও উজ্জ্বল নামে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ট্রাকড্রাইভার ও হেলপারসহ অন্তত পাঁচজন। তাদের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও গাজীপুর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে শিশু নিহত : ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অসীম (১০) নামে এক সাইকেল আরোহী শিশু নিহত হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় দক্ষিণ বটিনা গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। অসীম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ বটিনা গ্রামের ধনীরামের ছেলে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, বগুড়ার শেরপুরে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে ইদু মিস্ত্রি (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ইদু শেরপুর উপজেলার বার্নিঘাট এলাকার বাসিন্দা।
গতকাল বিকাল ৫টায় শেরপুরের মহিপুর জামতলা নামক স্থানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসের পেছনে ধাক্কায় দেয়। এতে সিএনজিটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং ইদু ঘটনাস্থলেই মারা যান। সিএনজিতে থাকা চালকসহ পাঁচ যাত্রী আহত হন।