বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শোকে স্তব্ধ নাটোর

দাফন সম্পন্ন ৩৩ জনের

শোকে স্তব্ধ নাটোর

নাটোরের বড়াইগ্রামে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো এলাকা। নিহত ৩৫ জনের পরিবারে চলছে মাতম। গতকাল নিহত সবার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তবে নিহতদের মধ্যে ৩৩ জনের পরিচয় জানা গেলেও দুজনের পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। গতকাল জানাজা আর দাফনের সময় উপস্থিত স্বজন আর জনতার উচ্চৈঃস্বরের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। এর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘটনাস্থল, হাসপাতাল ও সিধুলী গ্রাম পরিদর্শন করে নিহতের পরিবারকে এক লাখ করে টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন। দুর্ঘটনায় নিহত এলজিইডির গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের (৬০) লাশ রাতেই উপজেলা প্রশাসন তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার।
গ্রামে গ্রামে জানাজা মাতম : দুই বাসের সংঘর্ষে নিহত ৩৫ জনের মধ্যে গুরুদাসপুরের সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সিধুলী গ্রামের একই পরিবারের ছয় ভাইসহ ১২ জনের জানাজা হয়েছে। এলজিইডির অফিস সহকারী রেজাউল করিমের জানাজার নামাজ সকাল ১০টার দিকে গুরুদাসপুর শহীদ শামসুজ্জোহা ডিগ্রি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিধুলী গ্রামে আরও দুজনের জানাজা সন্ধ্যার আগে করা হয়। নিহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুসের জানাজা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার গ্রামের বাড়ি বড়াইগ্রাম উপজেলার পিঙ্গইনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস ও বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুননেছা উপস্থিত ছিলেন। সংগ্রামপুরে জানাজা হয়েছে আবদুর রহমান ও তার স্ত্রী আরিফা বেগমের। একই এলাকার বাজিতপুর গ্রামে আয়নাল হক ও কিসমত আলীর জানাজা হয়েছে। একই সময়ে পার্শ্ববর্তী জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও তার ভাগ্নি সেবা ওরফে মোহনার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব জানাজার সময় স্বজন ও উপস্থিত লোকজনের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
সিধুলী গ্রামে ১৪ জনের জানাজা : দুর্ভাগা নিহতদের মধ্যে ১৪ জন সিধুলী গ্রামের। এদের মধ্যে ১২ জনের জানাজা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় এবং অন্য দুজনের জানাজা জোহরের নামাজের পর সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হয়েছে। স্থানীয় গোরস্তানে একই সঙ্গে ১২টি এবং অন্যপাশে দুটি কবরে পরে তাদের দাফন করা হয়। নিহতদের জানাজার জন্য বাড়ি থেকে লাশগুলো স্কুল মাঠে নেওয়া হচ্ছিল তখন পুরো সিধুলী গ্রাম যেন কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য জানাজায় আগত দুই উপজেলার হাজারো মানুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। জানাজায় এলাকার সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ অংশ নেন। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের আরও দুজন নিখোঁজ বলে জানিয়েছে গ্রামের মানুষ।
নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে অনুদান : এই দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রী গত পরশু রাত ১টার দিকে গুরুদাসপুরের সিধুলী গ্রামের হতাহতদের দেখতে সেখানে গেলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রী সেখানে নিহত প্রত্যেককে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নগদ এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা  দেন। এর আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে তিনি বড়াইগ্রামের বনপাড়া আমিনা হাসপাতাল ও পাটোয়ারী হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং প্রত্যেকের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করবে বলে ঘোষণা দেন। এর আগে মন্ত্রী বড়াইগ্রামে দুই বাসের সংঘর্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
অথৈ পরিবহন অথৈ সাগরে ভাসিয়ে নিল ৩০টি পরিবারকে : সোমবার বিকালে দুই বাসের সংঘর্ষে যে ৩৫ জন নিহত হয়েছে তার মধ্যে নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী যাত্রীবাহী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালকসহ যাত্রী ছিল ৩১ জন। জেলা শহর থেকে ঘরে ফেরার জন্য অথৈ পরিবহনের যাত্রী হয়ে তারা গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। কিন্তু বড়াইগ্রামের রেজির মোড়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ে। নিহতরা হলেন, বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন, তার মেয়ে জান্নাতী, একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আলাল উদ্দিন, সংগ্রাম পুরের আবদুর রহমানের স্ত্রী আতিকা বেগম, খোকসা গ্রামের কৃষ্ণ পদ সরকার, ইন্দ্রাপাড়া গ্রামের জান মোহাম্মদ, বাজিতপুর গ্রামের কিসমত আলী, আবদুল কুদ্দুস, জোনাইলের আবদুর রহমান, রহমত আলী, জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম, গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, এসও রেজাউল করিম, একই উপজেলার সিধুলী গ্রামের এবাদ আলী, শরীফ উদ্দিন, লাবু, আলাল, সোহরাব হোসেন, আয়নাল হক, সতের আলী প্রামাণিকের দুই ছেলে রব্বেল আলী ও আতাহার আলী, বৃ-চাপিলা গ্রামের বাবুল, আবদুল আওয়াল, তেলটুপি গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে মোহনা খাতুন, পাটপাড়া গ্রামের জকের আলী, সোনাবাজু গ্রামের আবু হানিফ, সিধুলী গ্রামের কহির, তোফাজ্জল, চাঁচকৈড় বাজারের আলহাজ আবুল খায়ের এবং অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালক আলম হোসেন (৪০)। ৩০টি পরিবারেই এখন চলছে শোকের মাতম। নাটোরের মানুষের মুখে মুখে এখন একটাই কথা ওরা অথৈ পরিবহনে যাত্রী হয়ে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে গেল।
তদন্ত কমিটির কাজ শুরু : নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা সোমবার রাত থেকেই কাজ শুরু করেছেন।
অভারটেকিং প্রাণ নিয়েছে মানুষগুলোর : ৩৫ জন নিহত ও অর্ধশত আহত হওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল অভারটেকিং। দুর্ঘটনা কবলিত কেয়া পরিবহনের পিছনে প্রাইভেটকার নিয়ে আসা বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন জানিয়েছেন, কোচটি একই দিকে যাওয়া অন্য একটি ট্রাককে অভারটেক করে সামনে যাওয়ার সময় হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা অথৈ পরিবহনকে দেখতে পায়। পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কেয়া পরিবহন সজোরে অথৈ পরিবহনকে ধাক্কা দেয়। এ সময় বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়। এরপর বাস দুটি সড়কের দুই পাশের দুটি গর্তে সিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রাস্তা ও আশপাশে আহত ও নিহতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। এ সময় আহতদের আর্তচিৎকারে শত শত এলাকাবাসী উদ্ধার করতে ছুটে আসে। খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর-দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস ও থানা এবং হাইওয়ে পুলিশ এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা চালায়।
এদিকে নাটোরের পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক জানান, নিহতের স্বজনদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে প্রথমে লাশগুলো রাখা হয়। গতকাল দুপুরের মধ্যেই ৩৩টি লাশ হস্তান্তর করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর