শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি সম্পর্কে জানে না সরকারই

ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি সম্পর্কে জানে না সরকারই
প্রযুক্তি জীবনকে আগের চেয়ে অনেক সহজ করেছে এটি সত্য তবে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকটিও বেশ উদ্বেগজনক। প্রযুক্তির কল্যাণে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স পণ্যগুলো জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি এনেছে। কিন্তু এ পণ্যগুলোই যখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন তা বিপদ ডেকে আনছে। নষ্ট বা পুরনো কম্পিউটার, পুরনো মোবাইল ফোনসেট, টিউব লাইট, নষ্ট টিভি, অকেজো রেফ্রিজারেটর, ভিসিআর ও নষ্ট হওয়া ফ্যাক্স মেশিন, বৈদ্যুতিক বাল্ব, বিনোদনমূলক অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রীগুলোকেই ই-বর্জ্য বলে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রীকে বর্জ্য হিসেবে বিবেচনায় না আনায় সেসব যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। ইলেকট্রনিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সহজে মাটির সঙ্গে মেশে বা পচে না। এতে মাটি ও পানি উভয়ই দূষিত হচ্ছে। পরিবেশবিদরা জানান, দেশে ই-বর্জ্য ব্যবহারের কোনো নীতিমালা নেই। আর নীতিমালা না থাকায় ই-বর্জ্য থেকে পরিবেশ দূষণ ও ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এমনকি যারা ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করে এ বর্জ্য উৎপন্ন করছেন তারাও এ সম্পর্কে সচেতন নন। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করেন তাদেরই এ থেকে উৎপন্ন বর্জ্য রিসাইক্লিনিং করার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে এ জন্য একটি রিসাইক্লিং শিল্প গড়ে তোলা উচিত। এক দশক আগেও বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখনাকার মতো এত বেশি কম্পিউটার ছিল না। আগে সিআরটি (ক্যাথোড রে টিউব) মনিটর ছিল। সে জায়গা এখন দখল করেছে এলসিডি (লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে) বা এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়োড) প্রযুক্তি। শুধু কম্পিউটারই নয়। টিভির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তবে আগের সিআরটি মনিটরগুলো কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এ প্রতিবেদক সম্প্রতি প্রায় ১০টি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন যে, এলসিডি ও এলইডি প্রযুক্তির বাংলাদেশে আসার পর তারা টিভি ও কম্পিউটারের মনিটর বদলে ফেলেছেন। আর পুরনো মনিটরটি বাসার স্টোর রুম কিংবা কোনো এক কোনে গৃহসজ্জার উপকরণে পরিণত হয়েছে। এসব পরিবারের অনেকে এও জানান, মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। বাজারে নিত্যনতুন মোবাইল হ্যান্ডসেট এসেছে। আর পুরনো মোবাইলের আর ব্যবহার হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে ১০-১২ বছর আগের হ্যান্ডসেটগুলোর দাম এতই কম যে তারা তা বিক্রি করারও প্রয়োজন বোধ করেন না। এতে এ মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলো তাদের ঘরের অব্যবহৃত অবস্থায় বহুদিন পড়ে আছে। এর সঙ্গে অনেক পরিবারের অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ভিসিআর, ডেস্ক প্লেয়ারের মতো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি।
পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে মোট ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ১০.১০ মিলিয়ন টন বা এক কোটি টনের বেশি। আর প্রতিদিন তৈরি হয় ৫০০ টন ই-বর্জ্য। এর আগের অর্থবছরগুলোতে ছিল যথাক্রমে ৭.১৪ ও ৫.১৮ মিলিয়ন টন বর্জ্য। অর্থাৎ প্রতিবছর দেশে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে জাহাজ ভাঙার শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। শুধু মোবাইল ফোন থেকে বছরে হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি হয়। আর টেলিভিশন থেকে বছরে ১ লাখ ৭০ হাজার টন। ডিভিডি প্লেয়ার, ভিডিও ক্যামেরা, ফ্যাক্স ও ফটোকপি মেশিন, ভিডিও গেমস, মেডিকেল ও ডেন্টাল সরঞ্জামাদি থেকে ১ লাখ টনের বেশি ই-বর্জ্য হয়।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩২ কোটি টন ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করা হয়। তবে এর মধ্যে পুনর্ব্যবহার উপযোগী করা হয় মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পণ্য। এ ছাড়া দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি কম্পিউটার আমদানি করা হচ্ছে। তবে পুরনো ও নষ্ট হওয়া কম্পিউটারগুলো কী হচ্ছে তা জানা নেই। গবেষণায় জানা যায়, কম্পিউটারের বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। যা থেকে তৈরি হচ্ছে ল্যাকটেটস। এটি মাটির নিচে পানিকে দূষিত করছে। এ ছাড়া বাসা-বাড়ির আশপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা ই-বর্জ্য থেকেও ভয়াবহ মাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন বড় বড় সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ইলকট্রনিক পণ্যগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
ইএসডিও’র গবেষণায় দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ মানুষ ই-বর্জ্য শহরের ডাস্টবিনে ফেলছেন। সেখানে এগুলোর রিসাইক্লিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। রাজধানীর ধোলাইখাল, সদরঘাট, চকবাজারসহ পুরান ঢাকার কিছু জায়গায় পুরনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী কেনা-বেচার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব স্থানে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈদ্যুতিক সামগ্রীর পুনরুৎপাদন ও পুনর্ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেশে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বিনাশের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুটি বিভাগে করা সমীক্ষায় দেখা গেছে এই বর্জ্যরে ব্যবসা ও সংশ্লিষ্ট কাজে প্রায় ১ লাখ মানুষ জড়িত। অন্যদিকে ৫০ হাজার শিশু ইলেকট্রনিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনরুৎপাদনের কাজ করে। এই শিশুদের ১৫ শতাংশের অকাল মৃত্যু হয়।
ই-বর্জ্য ও পুনরুৎপাদন কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিয়মিত সিসা, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, অক্সিন ও ফিউরানের মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ও গ্যাসের সংস্পর্শে আসে। এই রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি মানবদেহেরও ক্ষতি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে ই-বর্জ্যরে সংস্পর্শে যারা আসে তাদের মধ্যে কিডনি রোগ, কানে কম শোনা, হাঁপানি, ক্যান্সার ও øায়ুবিক দুর্বলতা দেখা দেয়। এ ছাড়া ই-বর্জ্যরে কারণে মাথা ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ে চিড় ধরা, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, শিশুদের হজমে সমস্যা, গর্ভপাত, নবজাতক শিশুরা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ভেসেল কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে। কনভেনশনের শর্তানুযায়ী ইলেকট্রনিক বর্জ্য বিষয়ক একটি নীতিমালা বাংলাদেশের তৈরি করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তা তৈরি করেনি। এদিকে ই-বর্জ্যরে ভয়াবহতার কথা স্বীকার করে পরিবেশবাদীরা বলছেন, গেল এক দশকে ই-বর্জ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংকটে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছে। ২০১২ সালে ইলেকট্রনিক বর্জ্য নিয়ে ‘ডিসপোজাল ম্যানেজমেন্ট রুল’ নামে একটি আইনের খসড়া পরিবেশ অধিদফতর থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপক বিপন কুমার সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ কথা ঠিক যে, মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্যে পরিবেশ ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ইলেকট্রনিক বর্জ্যকে আলাদা করে শ্রেণিবদ্ধ করার কথা। তবে ই-বর্জ্যকে আলাদা বর্জ্য হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ না করায় করপোরেশনের লোকজন অন্য সাধারণ আবর্জনার মতোই ই-বর্জ্য ডাস্টবিন থেকে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এ পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য পরিষ্কার করার কথা না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, ইলেকট্রনিক বর্জ্য অপসারণে পরিবেশ অধিদফতর আইনগতভাবে এখনো কোনো নীতিমালা তৈরি করেনি। তিনি বলেন, পরিবেশ আইনের আওতায় শাস্তির বিধান রেখে ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি বিধিমালা তৈরি করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর