শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

বিএসইসি ভবনে ফের আগুন

* আমার দেশ কার্যালয় পুড়ে ছাই * এনটিভি আরটিভির সম্প্রচার বন্ধ * নাশকতার অভিযোগ * তদন্ত কমিটি

বিএসইসি ভবনে ফের আগুন

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) ভবনে আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল দুপুরে ভবনটির ১১তলায় অবস্থিত ‘আমার দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন ধরে গেলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ২০টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু দুই ঘণ্টার আগুনে ছাই হয়ে যায় পত্রিকা অফিসের যাবতীয় মালামাল। একই ফ্লোরে থাকা একটি ল’ চেম্বারও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ওই ভবনে থাকা অন্য দুই ফ্লোরের বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভি ও আরটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় অবশ্য এনটিভির সম্প্রচার শুরু হয়।  ফায়ার সর্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, দুপুর পৌনে ১২টায় ওই ভবনে আগুন লাগার খবর পেয়ে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান। তিনি বলেন, কোনো হতাহত বা কেউ আটকে রয়েছেন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। শুক্রবার সরকারি বন্ধ থাকায় ভবনের অন্য অফিসও ছিল বন্ধ। যে কারণে মানুষজনও ছিল কম। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা ফায়ার সার্ভিসের। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ মাহাবুব জানান, ওই কার্যালয়ে কাগজ, চেয়ার, টেবিলসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ ছিল বলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমার দেশ পত্রিকার কর্মীরা বলছেন, পত্রিকা অফিসের জেনারেল সেকশনের স্টোর রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। স্টোর রুমে কাগজ, আইপিএসসহ বৈদ্যুতিক বহু সামগ্রী ছিল।  আমার দেশ পত্রিকার কার্যালয় নিকেতনে স্থানান্তরের কারণে ওই ভবন থেকে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। মালামাল স্থানান্তরের দিনই এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল। অগ্নিকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই অগ্নিকাণ্ডকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন। কেউ আবার নাশকতা বলেও দাবি করেছেন। পুরো ঘটনার তদন্তে দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও বিএসইসি কর্তৃপক্ষ কমিটি দুটি গঠন করে। এনটিভি, আরটিভি, আমার দেশ এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে ওই ভবনে। গতকাল ছুটির দিন থাকায় অধিকাংশ অফিস ছিল বন্ধ। কিন্তু মিডিয়া হাউসগুলো ছিল খোলা। এনটিভিতে চলছিল রিপোর্টারদের একটি কর্মশালা। আগুনের সংবাদ ভবনে ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে অনেকেই ফায়ার সার্ভিসের মহড়া ভেবেছিল। পরে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা এবং সেই তাপ ছড়িয়ে পড়ায় বেসরকারি চ্যানেল দুটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তখন ভবনটির উত্তর দিকের জরুরি সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরো এলাকা ও আশপাশের ভবনগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ভবনটি ঘিরে রাখে পুলিশ ও র‌্যাব। আগুনের সংবাদে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ ও র‌্যাবকে হিমশিম খেতে হয়। আগুন থেকে রক্ষার জন্য পাশের বাপেক্স ও পল্লীভবন পানি দিয়ে ভেজানো হয়। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি একই ভবনে আগুন লেগে এনটিভি, আরটিভি ও আমার দেশসহ ১০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় পুড়ে যায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিনজন। আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনটিতে এক হাজারের বেশি মানুষ আটকা পড়েছিল। ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদেন বিগত সাড়ে সাত বছরেও প্রকাশ করা হয়নি। গতকাল অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ঘটনাস্থল আসেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এনটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রমুখ। আগুন লাগার পর ভবনের ১১তলা থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এরপর পুরো এলাকার আকাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে সামনে ও পেছনে দুটি লম্বা মই লাগিয়ে পানি ও ফোম ছিটাতে শুরু করেন। কিন্তু আগুনের তীব্রতা ও ধোঁয়ার কারণে তাদের কাজ করতে চরম অসুবিধা হচ্ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী বহু দূর থেকেও দেখা যায়। ভবনটির চারদিকে ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি রেখে আগুন নেভানোর কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আগুনের তীব্রতা কমে এলেও ভবনের ভেতর প্রচুর ধোঁয়া জমে যায়। ধোঁয়া বের করতে ভবনের বেশ কিছু জানালার কাচ ভেঙে ফেলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ধোঁয়া নিষ্কাষণ যন্ত্র দিয়ে ধোঁয়া বের করা হয়। বেলা ২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নির্বাপণ করতে বিকাল ৪টা গড়িয়ে যায়।
ভবন থেকে ভেঙেপড়া কাচের টুকরা লেগে ঘটনাস্থলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রতিবেদক মারুফ আল মুহিত আহত হন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত আমার দেশ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার নাসিরউদ্দিন আহমেদ সোয়েব জানান, গতকাল পত্রিকা অফিসের মালামাল স্থানান্তর করা হচ্ছিল। সকাল থেকেই মালামাল নামানোর কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। এর আগে ভবনের ভাড়া আটকে যাওয়া নিয়ে বিএসইসি ভবন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে সমস্যা হচ্ছিল তা গত বৃহস্পতিবার রাতেই মিটে যায়। যে কারণে শুক্রবার সকাল থেকেই মালামাল সরানোর কাজ শুরু হয়। ভবনের নিচে মালামাল নিয়ে যাওয়ার জন্য পিকআপও ছিল রেডি। শ্রমিকরা কাজ করার সময়ই দেখতে পান স্টোর রুম থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ড যেখান থেকে সূত্রপাত হয়, সেখানেই উপস্থিত ছিলেন পত্রিকার অফিস সহকারী আব্বাস আলী হাওলাদার। তিনি বলেন, আমরা অফিস পরিবর্তনের জন্য কয়েকটি এসি ও চেয়ার লিফটে করে নামিয়েছি। আরও মাল নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এ সময় উত্তর-পূর্ব দিকের স্টোর রুম থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে দেখি। স্টোর রুম ছিল তালাবদ্ধ। স্টোর রুমের চাবি যার কাছে থাকে, তাকে ফোন করে ডেকে আনা হয়। পরে চাবি দিলে খুলে নিজেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমরা দেখতে পাই ধোঁয়া বাড়ছেই। হঠাৎ আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখে ভয় পেয়ে যাই। আমাদের মধ্যেই কেউ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। আর সবাই ১১তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে যাই।
পত্রিকাটির সিনিয়র রিপোর্টার মাহমুদা ডলি জানান, আমার দেশ পত্রিকার সার্ভার ও আর্কাইভ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। দীর্ঘদিন অফিস পরিবর্তনের কথা বলা হলেও বিএসইসি কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এখন অফিস পরিবর্তনের মুহূর্তে এমন ঘটনা ঘটল তাতে এটি যে পরিকল্পিত, তা বোঝা যাচ্ছে। সরকারের লোকজন পরিকল্পিতভাবে আমার দেশ অফিসে আগুন ধরিয়েছে। সরকার আগেই আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করেছে এখন অফিসে আগুন দিয়ে এর কবর রচনা করল।
তবে আমার দেশ পত্রিকার অন্য এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ইতিমধ্যে নিকেতনের নতুন অফিসে নেওয়া হয়েছে। পত্রিকাটির কাছে অনেক কর্মীর বেতন পাওনা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে সেটি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল কী না তাও খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। নির্দিষ্ট করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির একজন বার্তা সম্পাদক আক্তার হোসেন জানান, ভবনের ছয়তলায় তাদের কার্যালয়। সপ্তম থেকে নবমতলায় এনটিভি এবং ১১তলায় আমার দেশের কার্যালয়। এ ছাড়া ছাদের ওপর দুটি টিনশেড কক্ষে এনটিভির ট্রান্সমিশন স্টেশন।
এনটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক (সিএনই) জহিরুল আলম ও আরটিভির বার্তা সম্পাদক আনোয়ার হক জানান, আগুন লাগার পর ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন হয়ে গেলে দুপুর ১২টার দিকে তাদের চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আগুন নেভানোর কাজ যখন চলছে, তখনই বিএসইসি ভবনের নিচে পৌঁছান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ২০০৭ সালে এ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তার প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমি বিষয়টি দেখব। এখন আমার জানা নেই।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এর আগেও এই ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে, যা রহস্যজনক। ঘটনাটি নাশকতা বলে মনে হচ্ছে, জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তিনি অবিলম্বে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।
আগুন লাগার খবর পেয়ে এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আলী ফালু ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বারবার এ ভবনে আগুন লাগে, আর আমি বারবারই ক্ষতিগ্রস্ত হই। তদন্ত হয়, কিন্তু রিপোর্ট পাই না। তদন্ত কি হয় তা জানা যায় না। বার বার এ ভবনে আগুন লাগে কেন তা জানা দরকার। আমি সবার দোয়া চাই।’ আমার দেশ কার্যালয় স্থানান্তরের বিষয়টি জানা ছিল না বলে জানান পত্রিকাটির সাবেক এই মালিক।
বিএসইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসেন চৌধুরী জানান, সংস্থার পরিচালক (অর্থ) সৈয়দ মোজাম্মেল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
‘আমার দেশ’ কর্তৃপক্ষের দাবি
এদিকে অগ্নিকাণ্ড রহস্যজনক বলে জানিয়েছে আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে এ ক্ষতি বহন করা আমার দেশের পক্ষে সম্ভব নয় বলেও তারা জানান। গতকাল বিকালে বিএসইসি ভবনের নিচে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।
দমকল বাহিনীর বরাত দিয়ে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পত্রিকাটির মেইন সার্ভার, প্রোডাকশন রুম, ডজন ডজন কম্পিউটার, রেফারেন্স, সংরক্ষিত পত্রিকা এবং ১১ বছরের যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ ছাই হয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আমার দেশের বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, নগর সম্পাদক এম আবদুল্লাহ, ক্রীড়া সম্পাদক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ড্যাবের মহাসচিব এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএফইউজের মহাসচিব এম এ আজিজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, সাংবাদিক নেতা বাছির জামাল প্রমুখ।
সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, প্রায় দেড় বছর আগে সরকারি রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশ সরকারি মালিকানাধীন বিএসইসি ভবন কর্তৃপক্ষের দেনা-পাওনার বিষয়টি সুরাহা করে শুক্রবার অন্যত্র শিফট করছিল। সকালে অফিস স্থানান্তরের কাজ শুরু হওয়ার পরই এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ খবর