মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

লতিফে উত্তপ্ত সংসদ

স্পিকার বললেন গ্রেফতারে অনুমতির প্রয়োজন নেই

লতিফে উত্তপ্ত সংসদ

আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে গতকাল সাধারণ মানুষ ও সরকারের ভিতরে ছিল নানা আলোচনা। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদ অধিবেশন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সদস্যরা অবিলম্বে তার গ্রেফতার দাবি করেন। লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সামনে দিয়ে নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে চলে যাওয়ার ঘটনায় সংসদ সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি এখনো সংসদ সদস্য আছেন কিনা সে ব্যাখ্যাও তারা স্পিকারের কাছে দাবি করেন। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সরকার আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছে। সাবেক এ মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হবে, নাকি তিনি আদালতে যাবেন, এমন জিজ্ঞাসা ছিল সব মহলের। লতিফ সিদ্দিকী সংসদে যেতে পারেন এমন গুঞ্জনে সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে সাংবাদিকদের ক্যামেরা ছিল সতর্ক। তাকে গ্রেফতার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্পিকারের অনুমতি লাগবে বলে ব্যাখ্যা দেন। তবে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারে তার কোনো অনুমতি লাগবে না। 

সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে ৩টা ৪৫ মিনিটে নিজ কার্যালয়ে স্পিকার সাংবাদিকদের বলেন,  কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী শুধু সংসদ লবি, গ্যালারি ও চেম্বার থেকে কোনো সংসদ সদস্যকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া কোনো অনুমতি লাগে না। এদিকে গতকাল সকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বহিষ্কৃত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করতে স্পিকারের অনুমতি লাগবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্পিকার বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেটি বলেছেন তা ঠিক নয়। এটি স্পিকারের কোনো বিষয় নয়। তবে প্রচলিত আইনে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার ১৪ দিন আগে ও সংসদ অধিবেশন শেষ হওয়ার ১৪ দিন পর্যন্ত কোনো সিটিং এমপিকে গ্রেফতার করা যাবে না বলে বলা আছে। এটিও ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান আমলের আইনে বলা আছে। সেই আইনের কারণেই তাকে গ্রেফতারে বিভ্রান্তি হচ্ছে। স্পিকার বলেন, তবে কোনো সংসদ সদস্যকে গ্রেফতার করা হলে তাকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্পিকার সংসদে থাকলে সংসদে জানাতে হবে, না থাকলে চিঠি দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন চলাকালে কোনো সংসদ সদস্য গ্রেফতার করার বিষয় আমাকে অবহিত করা হলে, আমি সংসদে তা পাঠ করে শোনাব।’ এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, ‘নবম জাতীয় সংসদে স্পিকার থাকাকালেও সিটিং এমপিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমাকে অবহিত করার পর আমি সেটি সংসদে পাঠ করে শুনিয়েছি।’ লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফেরার আগে স্পিকারকে অবহিত করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে জানানো হয়নি। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা প্রসঙ্গে কোনো চিঠি তিনি পাননি বলেও জানান স্পিকার। উল্লেখ্য, গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বহিষ্কৃত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করতে স্পিকারের অনুমতি লাগবে। প্রতিমন্ত্রী  বলেন, স্পিকারের অনুমতি ছাড়া বহিষ্কৃত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনের ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সংসদের অধিবেশন চলমান রয়েছে, আর তিনিও সংসদ সদস্য পদে এখনো বহাল রয়েছেন। সে কারণে তাকে গ্রেফতারে জাতীয় সংসদের স্পিকারের অনুমতি প্রয়োজন। লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করতে পুলিশের কোনো ব্যর্থতা রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের  কোনো ব্যর্থতা নেই। গ্রেফতারে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে যেমন সত্য, তেমনি তিনি এখন সংসদ সদস্য রয়েছেন সেটিও সত্য। তাকে গ্রেফতারে আইনি জটিলতা আছে।’ 

সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা : এদিকে গতকাল জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবি করে আলোচনার সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন এ বিষয়ে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন স্বতন্ত্র সদস্য হাজী মো. সেলিম, রুস্তম আলী ফরাজী, বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদ এবং সরকারি দলের সিনিয়র সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, যেখানে তার নামে ওয়ারেন্ট আছে, তাহলে কীভাবে শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে তিনি নিরাপদে চলে যেতে পারলেন! বিমানবন্দরে এতগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থাকার পরও তিনি প্রবেশ করেছেন। কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীকে, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে ইচ্ছা করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। এ সুযোগে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। তিনি মৌলবাদীদের পক্ষেই কাজ করেছেন। তাই তাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। তিনি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। একই প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র সদস্য হাজী সেলিম বলেন, বিমানবন্দরে এত গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে কীভাবে তিনি দেশে আসতে পেরেছেন! জনগণ বলছে, তিনি সরকারের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে দেশে ফিরেছেন। স্পিকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘তাকে পার্লামেন্ট থেকে বিদায় করবেন কি না এটা আপনার ব্যাপার।’ যে কোনো ওয়াজ মাহফিলে গেলে মাওলানা মুন্সিরা লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শঙ্কিত।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ প্রসঙ্গে ৩০০ বিধিতে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান হাজী সেলিম। লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ আছে কি না, এ বিষয়ে স্পিকারের রুলিং দাবি করেন স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী। তিনি বলেন, আইনগতভাবে তার নামে ওয়ারেন্ট আছে ২২টি। তিনি এমপি আছেন কি না এ বিষয়ে স্পিকার  রুলিং দেবেন। তা না হলে ইসিতে পাঠিয়ে তিনি এমপি আছেন কি না, সেটি ঠিক করতে হবে। রুস্তম ফরাজী বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখলে চলবে না। তার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত স্পিকারকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনএফ সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, লতিফ সিদ্দিকী দেশের নাগরিক। তিনি এখনো সংসদ সদস্য। তবে এ বিষয়ে স্পিকার সিদ্ধান্ত দেবেন। 

বিরোধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দলের প্রবীণ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত  বলেন, ‘সরকার সরকারের কাজ করেছে, দল দলের কাজ করেছে। তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়েছে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ, এমনকি প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এটি কার্যকরের দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার।
তাকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এ বিষয়ে আমরা আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি।’ সংসদের কার্যবিধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগে যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকে, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সেটি কার্যকর করতে হবে। গ্রেফতারের পর স্পিকারকে তা জানাতে হবে। তিনি জানলেই সংসদকে বিষয়টি অবহিত করবেন। তিনি আরও বলেন, ‘লতিফ সিদ্দিকী যে কথা বলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন, আমি মনে করি এ সংসদসহ আওয়ামী লীগের সব সদস্য মর্মাহত হয়েছেন।’ তিনি বলেন, আইন আইনের মতো চলবে। তবে এ বিষয়টি সামনে নিয়ে কেউ যদি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেন, তাহলে সেটি মনে হয় একটু বেশি হয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর