বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

তদন্ত হচ্ছে লতিফের দুর্নীতির

তদন্ত হচ্ছে লতিফের দুর্নীতির

সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপির বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে। বিশেষ করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাবস্থায় সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি বিনা টেন্ডারে বিক্রি, হস্তান্তর ও ইজারা দেওয়ার অভিযোগগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হবে। ইতিমধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে লতিফ সিদ্দিকীর সব অনিয়ম-দুর্নীতির নানা তথ্য-উপাত্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
রবিবার রাতে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে কলকাতা থেকে ঢাকা ফেরেন লতিফ সিদ্দিকী। সোমবার দিনভর ছিলেন আত্মগোপনে। আর মঙ্গলবার দুপুরে নিজেই আত্মসমর্পণ করেন ধানমন্ডি থানায়। সেখান থেকে তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির একটি অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন সরকারের তৎকালীন এই মন্ত্রী। এর পরপরই তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকেও বাদ দেওয়া হয় লতিফ সিদ্দিকীকে। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কারণে ওই সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলাও হয়। এসব মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এ অবস্থায় নিউইয়র্ক থেকে দেশে না ফিরে কলকাতায় অবস্থান করেন সরকারের এই সাবেক মন্ত্রী। মন্ত্রী থাকাবস্থায় দুর্নীতির ‘মহারাজা’ হিসেবে পরিচিত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বিগত মহাজোট সরকারের সময় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একের পর এক দুর্নীতির মাধ্যমে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের সম্পদ পানির দরে বিক্রি করেছিলেন। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিজে হয়েছেন বিত্ত-বৈভবের মালিক। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে গঠিত কমিটির তদন্তেও বের হয়ে এসেছে সাবেক এই মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন খতিয়ান। ইতিমধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে, যাতে লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির প্রায় অর্ধশত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তদন্তে বের হওয়া দুর্নীতির এসব অভিযোগের বিষয়ে কারাগারে আটক লতিফ সিদ্দিকীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর বাইরে বর্তমান সরকারের আমলে তিনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সেখানেও তার বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তদন্ত করা হবে। ক্ষমতার দাপটে বিগত মহাজোট সরকারের সময় সরকারি নিয়মকানুন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি তৎকালীন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজের একক সিদ্ধান্তে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন তিনি। তার ভয়ে সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন তটস্থ আর অসহায়। সরকারি নিয়মকানুন কিংবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো কথাই মন্ত্রী আমলে নিতেন না। নিজেই সব সিদ্ধান্ত দিতেন। আর এভাবেই নিজের একক সিদ্ধান্তে তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী থাকাবস্থায় বিনা টেন্ডারে সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্তত ৪৮টি সম্পত্তি বিক্রি, ইজারা ও হস্তান্তর করেছেন, যাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। মন্ত্রীর নির্দেশমতো তড়িঘড়ি করে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে গিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এমনও বলেছেন, ‘নীতিমালা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করো।’ মন্ত্রীর এমন আচরণে তখন মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সব দফতর-অধিফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন একেবারেই অসহায়। সাবেক এই মন্ত্রীর এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানেও। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বর্ণনা দিয়ে ৪৮টি সম্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার সরকারের অনুকূলে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে। এ ছাড়া কমিটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিনা মূল্যে বিক্রি, হস্তান্তর ও ইজারা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিএমসি, তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত জুট করপোরেশন (বিজেসি) এবং বিজেএমসির মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনা টেন্ডারে দেওয়া হয়েছে ১২টি। ৪৮টির মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৭টি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এভাবে সম্পত্তি হস্তান্তরের কারণে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ছাড়া এসব ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালাও মানা হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৬টি প্রতিষ্ঠান বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মন্ত্রী যেসব অনিয়ম করেছেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যথাযথ মূল্য নির্ধারণ না করা, বিনা টেন্ডারে হস্তান্তর, কেবল মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিনা মূল্যে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া, বিক্রির আগে অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন না নেওয়া, বিক্রির শর্ত না মানা, আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই হস্তান্তরসহ আরও কিছু বিষয়।
গাজীপুরের বিখ্যাত মসলিন কটন মিলটি নয়-ছয় করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১১ সালে রিফাত গার্মেন্ট লিমিটেডের নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয় এটি। এটি হস্তান্তর করা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং এর দায়দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি বলেও কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুমিল্লার দৌলতপুরের চিশতী টেক্সটাইল মিলস বিনা টেন্ডারে ও কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে বলা হয়েছে, একইভাবে খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত বিজেসির সম্পত্তি পাট বেলিং কেন্দ্রটি বিক্রি হয়েছে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নির্দেশ অনুযায়ী। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এটি বিক্রির ক্ষেত্রে সমঝোতার মাধ্যমে দাম ঠিক করে বিক্রি করা হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে। ১৪ কোটি ৪২ হাজার ২১৩ টাকার ওই কেন্দ্রটি মাত্র পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া শ্রমিক ও কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করা চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ফ্যারিলিন সিল্ক মিলস নীতিমালা ভেঙে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে অবস্থিত নিউ লক্ষ্মী কটন মিলটি চুক্তি ও নীতিমালা-বহির্ভূতভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একইভাবে বিনা টেন্ডারেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে নেত্রকোনার সাবেক জুট বোর্ড ও বগুড়ার সুরজমহল আগরওয়ালা মিলটি। কুড়িগ্রামের ঘেউরচাঁদ মাঙ্গিলাল জমিটি নিষ্কণ্টক না করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ন্যাশনাল কটন মিল বিক্রির আগে মতামত নেওয়া হয়নি অর্থনৈতিক মন্ত্রিসভা কমিটির। বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা হয়েছে রাজধানীর হাটখোলার ঢাকেশ্বরী কটন মিলটি। কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে নাসিরাবাদের ভ্যালিকা উলেন মিল। এ ছাড়া জামালপুরের আর সিম প্রেস হাউস বিক্রির ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। একইভাবে বেসরকারিকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালা মানা হয়নি ফেনীর রানীর হাটের দোস্ত টেক্সটাইল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে গঠিত কমিটির তদন্তে যে ৪৮টি সম্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে এবং এগুলোর বিষয়ে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোর জন্যই এখন তদন্তের মুখোমুখি হবেন সাবেক এই ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। শীঘ্রই এ তদন্তের কাজ শুরু হবে।

সর্বশেষ খবর