শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সার্কে ৩৬ দফা ঘোষণা, শেষ মুহূর্তে বিদ্যুৎচুক্তি সই

* করমর্দন করলেন মোদি-নওয়াজ * শেষ হলো শীর্ষ সম্মেলন

সার্কে ৩৬ দফা ঘোষণা, শেষ মুহূর্তে বিদ্যুৎচুক্তি সই

সার্ক সম্মেলনে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আট দেশের নেতারা -এএফপি

দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারে অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার প্রতিশ্র“তিসহ ৩৬ দফা ‘কাঠমান্ডু ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে গতকাল শেষ হয়েছে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। টানাপোড়েনের পর শেষ মুহূর্তে সই হয়েছে বিদ্যুৎ চুক্তিটিও। কাঠমান্ডু ঘোষণায় বলা হয়- এখন সময় এসেছে নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার। এর আগে ২৬ নভেম্বর ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে, কাঠমান্ডুর ভ্রৃকুটি মণ্ডপে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় সভাগৃহের নগর মিলনায়তনে শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়। গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় কাঠমান্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুই দিনের সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টার পর থেকেই একে একে সম্মেলনস্থলে আসতে শুরু করেন সার্কভুক্ত আট দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা। সম্মেলনের ফাঁকে অবকাশযাপনে সকালেই সার্কের পর্যবেক্ষক নয়টি দেশের প্রতিনিধি দলকে সঙ্গে নিয়ে শীর্ষ নেতারা হেলিকপ্টারযোগে গিয়েছিলেন কাঠমান্ডু থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নেপালের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র নয়নাভিরাম ধুপিখেলের ‘দাওয়ারিকা রিসোর্ট’-এ। অবশ্য ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যেতে পারেননি। সম্মেলনের প্রথম দিনের বক্তৃতায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজেই পরবর্তী সার্ক সম্মেলন তার দেশে আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই আসন গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সার্কের বিদায়ী চেয়ারপারসন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি ও স্বাগতিক নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে পাকিস্তানকে নির্ধারণ করা হয়। এরপর ৩৬ দফা সংবলিত ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণা তথা ‘কাঠমান্ডু ঘোষণা’ অনুমোদন করা হয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সমাপনী ভাষণ দেন। সব শেষে সার্কের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের পক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সমাপনী বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বিকাল ৫টায় ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে। শেষ দিন নেপালের রাষ্ট্রপতি ড. রামবরণ যাদব সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে আসা নেতাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন।
মোদি-নওয়াজের করমর্দন : সকালে অবকাশ কেন্দ্রে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ অন্তরঙ্গ করমর্দন করেন। এটাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই দুজনের প্রথম সরাসরি আলাপ। সার্ক দেশগুলোর সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানরাও এ সময় একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। বেড়ানো ও আলাপের পাশাপাশি এক টেবিলে তারা খাওয়ার পর্বও শেষ করেন।
প্রধানমন্ত্রী ফিরছেন আজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮তম সার্ক সম্মেলন শেষে আজ দেশে ফিরছেন। সকাল সাড়ে ১০টায় নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে তিনি নেপাল ত্যাগ করবেন।
যা আছে কাঠমান্ডু ঘোষণায় : রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নতির জন্য আরও গভীর পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে জোরালো আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থ, জ্বালানি নিরাপত্তা, অবকাঠামো, সংযোগ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আরও বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে একমত হয়েছেন তারা। শীর্ষ নেতারা দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন আরও পরিকল্পিতভাবে কার্যকরের ব্যাপারে একমত হন। একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল, একটি শুল্ক ইউনিয়ন, একটি যৌথ বাজার এবং একটি যৌথ অর্থনৈতিক ও মুদ্রাবিষয়ক ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নকে কার্যকরের ব্যাপারেও তারা একমত হন। সার্কভুক্ত দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত এবং ভূমিবেষ্টিত দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে তাদের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এসব দেশ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়নে সার্কভুক্ত দেশ একে অন্যকে সহায়তার ব্যাপারে শীর্ষ নেতারা একমত পোষণ করেন। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মালামাল রপ্তানি ও অন্যান্য সেবাকে কীভাবে আরও সহজলভ্য করা যায়, তার কিছু সুনির্দিষ্ট উপায় বের করার ব্যাপারে একমত হন নেতারা। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত দুটি চুক্তির ব্যাপারে আগামী তিন মাসের মধ্যে সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে সভা করার বিষয়ে শীর্ষ নেতারা মতৈক্যে পৌঁছেছেন।
সার্কে জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষর : দক্ষিণএশীয় দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সহযোগিতার জন্য জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গতকাল নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্ক সম্মেলনের শেষ দিনে অনেকটা নাটকীয়ভাবে এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। নেপালে শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আট দেশের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ চুক্তিতে সই করেন। স্বাক্ষরিত ‘সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন’-এ আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে এক দেশের বিদ্যুৎ সহজেই অন্য দেশ কিনতে পারবে।
জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের পর জোটের নতুন চেয়ারম্যান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, অচিরেই সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি এবং সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরিবহনবিষয়ক মন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষে সন্ধ্যায় কাঠমান্ডুর হোটেল রেডিসনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। এই সম্মেলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হয়েছে এবারের সম্মেলন। সেখানে ৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণায় সার্ক দেশের নেতারা সব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশগুলোর জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের বিষয়ে একমত হয়েছেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার লক্ষ্যে আরেকটি চুক্তির বিষয়ে নেতারা একমত হয়েছেন, তিনমাসের মধ্যে দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। এগুলো এই সার্কের অনেক বড় সফলতা। তিনি আরও বলেন, এবারের সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পরস্পরের কাছাকাছি এসে করমর্দন করেছেন। এ সময় পুরো সম্মেলন হল করতালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়েছে। এটিও সার্ক সম্মেলনের এক বিরাট সফলতা। এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে কেবল বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের সব দেশই উপকৃত হবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনের একটি উজ্বল সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী ও উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন।

সর্বশেষ খবর