মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
সুন্দরবনে ট্যাংকার ডুবি

দূষণ নিয়ে সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি সরকার

ধাক্কা দেওয়া ট্যাংকারসহ চার কর্মী আটক

দূষণ নিয়ে সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি সরকার

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২০০২ সালে এক গবেষণায় সুন্দরবনের তেলদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করেছিল। ওই গবেষণায় সুন্দরবনের সম্ভাব্য তেলদূষণ রোধকল্পে বনকর্মীদের প্রশিক্ষণ, তেলদূষণ মোকাবিলায় প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুন্দরবন বিভাগ, মংলা বন্দর, কোস্টগার্ড, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়ে আপদকালীন পরিকল্পনা কাঠামো গড়ে তোলাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এমনকি ২০০৩ সালে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তেলদূষণ মোকাবিলায় পরিকল্পনা সনদেও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। এত কিছুর পরও সরকার সুন্দরবনে তেলদূষণ রোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি; যে কারণে সুন্দরবনে ফার্নেস অয়েল দুর্ঘটনা রোধ করা যায়নি। একটি সুসংবাদ- ডলফিনের দেখা মিলেছে। শ্যালায় ট্যাঙ্কার-ডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর ছয় দিনেও খোঁজ মিলছিল না ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের। অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন তেল ছড়িয়ে পড়ার পর ডলফিন মারা গেছে। আবার অনেকে বলছিলেন সুন্দরবন ছেড়ে চলে গেছে। না, তাদের কোনো ধারণাই সত্য হয়নি। ডলফিন সুন্দরবনেই রয়েছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে শ্যালার মোহনায় তাম্বুলবুনিয়া, ককিলমুনি, হরিণটানা, কটকা-কচিখালী এলাকায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। দল বেঁধে তারা ঘুরছে ফিরছে সেখানে। অনেক বনজীবীর কাছ থেকে একই তথ্য মিলেছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী গতকাল বিকালে এই সুসংবাদটি নিশ্চিত করেছেন। ট্যাঙ্কার-ডুবির ঘটনায় দায়ী চার কর্মচারীসহ এমভি টোটাল ট্যাঙ্কারটিকে গতকাল দুপুরে আটক করেছে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারি থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত আরও ১২ কিলোমিটার নতুন এলাকায় তেল অপসারণ শুরু হয়েছে। এ কাজে বনসংলগ্ন মংলা উপজেলার সাত-আটটি গ্রামের মানুষ অংশ নিয়েছেন। সুন্দরবন বিভাগের শতাধিক নৌকায় ২০০ শ্রমিক তেল অপসারণে কাজ করছেন। রবিবার দুপুর থেকে বাড়তি মূল্যে তেল কেনা হচ্ছে বলে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম বাবুল জানিয়েছেন। বন বিভাগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভাসমান তেল অপসারণে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার পদ্ম অয়েল কোম্পানি কেনে ৫ হাজার লিটার, শুক্রবার কেনে ১৮ হাজার লিটার ও রবিবার ১৭ হাজার লিটার। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কিনেছে ১৬ হাজার লিটার।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ : সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, পলি পড়ে ঘষিয়াখালী-মংলা আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেলটি ২০১১ সালের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বলেশ্বর-জয়মণিকে বিকল্প রুট হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। মাত্র তিন মাস নৌযান চলাচলের কথা বলা হলেও প্রায় চার বছর ধরে চলছে সব ধরনের নৌযান। সুন্দরবন বিভাগের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রতিদিন এই বিকল্প রুট দিয়ে প্রায় দুই শতাধিক জাহাজ ও কার্গো ভ্যাসেল চলাচল করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। মহাবিপর্যয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ক্ষতি হবে। 

সহস্রাধিক জেলে বেকার : পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জসংলগ্ন বাগেরহাটের মংলা উপজেলার জেলেরা নদী-খালে মাছ শিকার করতে না পারায় জীবিকা নির্বাহ করা সহস্রাধিক জেলে পরিবার বেকার সময় পার করছেন। শ্যালা নদীর খালে তেল ভেসে থাকায় তারা জাল ফেলে মাছ শিকার করতে পারছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সুন্দরবনের নদী-খালের ওপর নির্ভরশীল এসব জেলে পরিবারকে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর জেলেদের উদ্বেগ বাড়ছে। তবে বন বিভাগ বলছে, এই অবস্থা সাময়িক। 

আগেও তেলে ডুবে ছিল সুন্দরবন : শুধু এবার নয়। ১৯৯৪ সালে এমভি পাবলিনা নামের একটি বিদেশি জাহাজ মংলা বন্দরের অদূরে পশুর নদের বাণীশান্তা এলাকায় ডুবে যায়। ওই সময় পশুর নদে ভাটা থাকায় তেলের একটি বিরাট অংশ ভেসে নেমে যায় বঙ্গোপসাগরে। সে কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন।
কার্গোটিকে রূপান্তর করা হয় জ্বালানি ট্যাঙ্কারে : দেশের কুইক রেন্টালের জোয়ারের সময় হঠাৎ করেই কার্গোটিকে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাঙ্কারে রূপান্তর করা হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র না নিয়ে ছাড়পত্র নেয় পেট্রোবাংলার কাছ থেকে। 

সেই জাহাজ আটক মাস্টারসহ চারজন গ্রেফতার : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলবাহী ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ কে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এমটি টোটাল নামের ট্যাংকারটিকে আটক করা হয়েছে। ওই ট্যাংকার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে মাস্টারসহ চার নৌ শ্রমিককে। দুর্ঘটনার ছয় দিন পর গতকাল দুপুরে বন্দরের লক্ষণখোলা এলাকা থেকে বন্দর থানা পুলিশের সহযোগিতায় মংলা থানার এসআই মঞ্জু জাহাজটিকে আটক করেন।

ঘষিয়াখালী চ্যানেল উদ্ধার ও চিংড়ি ঘের সরানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর : ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগের পথ ঘষিয়াখালী চ্যানেল উদ্ধার এবং ওই চ্যানেলের সব চিংড়ি ঘের সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে ট্যাংকার দুর্ঘটনায় সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল সরিয়ে ক্ষয়ক্ষতি যেন আর না বাড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যও নির্দেশ দেন। গতকাল বাংলাদেশ সচিবালয়ে নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর গোপালগঞ্জ ও যশোরের জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে এসব নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে এই তেল সরিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, সুন্দরবনের বিষয়টি ভালো করে মনিটরিং করা দরকার, তেল সরানো এবং আর ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিএনপি সরকারের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ঘষিয়াখালী খাল অনেকদিন ড্রেজিং করা হয়নি। সিলড হয়ে গিয়েছিল। বিএনপির সময় মংলা বন্দরের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেজন্য এই দিকটায় কেউ আর খেয়াল করেনি। ঘষিয়াখালীর যে শাখা খালগুলো ছিল, তার মুখে চিংড়ি ঘের করে পানি আসার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘেরগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে এই ঘষিয়াখালী খাল চালুর কথা বলেছি। এর মুখ থেকে চিংড়ি ঘের সরিয়ে দিতে হবে, যাতে খালগুলো বন্ধ না হয়। দুই জেলার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রধানমন্ত্রী ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সম্মেলন আয়োজনের প্রশংসা করে বলেন, ডিসি-ডিএম সম্মেলন একটি ভালো উদ্যোগ। মাদক, চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার বন্ধে একটি ভালো উদ্যোগ। কারও একার পক্ষে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগ দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ খবর