বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

জঙ্গি অর্থায়নে ব্যাংক-বীমা!

দেশে জঙ্গি কার্যক্রম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের উৎস পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের আগ্রহে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এনবিআর সন্দেহজনক সাতটি ব্যাংক, ১১টি বীমা, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক-হাসপাতাল ও দেশি-বিদেশি এনজিওকে চিহ্নিত করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয়, ভূমিকা, তাদের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের নানা দিক নিয়ে তদন্ত করছে এনবিআরের কর গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জঙ্গি-মৌলবাদী অপশক্তিকে অর্থায়নে জড়িতদের ব্যাপারে ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। জানা গেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৮টি ব্যাংক-বীমা ও সেবা খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে সরকার। গত আগস্টে গঠিত ‘জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম অধিকতর সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স’-এর সভাপতি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জঙ্গি-মৌলবাদী এই অপশক্তিকে অর্থায়নে জড়িতদের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছে।
দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। তিনি বলেন, জঙ্গি ধরে শেষ করা যাবে না। এসব জঙ্গি-টঙ্গি শেষ করতে হলে তাদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস বন্ধ করতে হবে। সূত্র জানায়, দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকা পেয়ে আগস্টে অনুসন্ধানে নেমেছে এনবিআর। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তালিকা অনুসারে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখছে কর প্রশাসন। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল প্রতিনিধি এনবিআরের শীর্ষ এক কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় কোনো গরমিল আছে কি না, সেটি অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে বলে প্রভাবশালী এই গোয়েন্দা সংস্থাটির সূত্র জানায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের উৎস জানতে এবং কর ফাঁকি উদ্ঘাটনে কাজ চলছে ব্যাপক আকারে। এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। সূত্র আরও জানায়, ১৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতালের আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে কিংবা ভবিষ্যতে কাজের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে এমন কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের তথ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সরবরাহ করেছে এনবিআর। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কর বিভাগ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজটি করছে। কেননা সবাই জঙ্গি অর্থায়ন করে না। কেউ কেউ করে থাকে। তাই সুচারুভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কর প্রশাসনের দক্ষ, সৎ ও আর্দশবান কর্মকর্তাদের একটি টিম এ নিয়ে কাজ করছে। এদিকে জঙ্গি অর্থায়ন খুঁজে বের করতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুপারিশে বলা হয়, ইসলাম নামযুক্ত ১১টি বীমা কোম্পানি কাজ করে থাকে। এ ছাড়া সেবা খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের জঙ্গি অর্থায়নের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে দেখা উচিত। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এসব বীমা ও ক্লিনিক-হাসপাতাল বিভিন্ন খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। এসব অর্থের উৎস খুঁজে বের করা উচিত। দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবিরসহ অন্যান্য সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি সত্তর-আশির দশকে নামে-বেনামে দেশি-বিদেশি অর্থে গড়ে তোলে ‘ইসলাম’ নামধারী হাজারো প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এখন তাদের বার্ষিক আয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। মৌলবাদীদের এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয় করা অর্থ দিয়েই বিভিন্ন সময় নানা স্থানে জঙ্গি হামলা চালানো হয়ছে বলে মনে করেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, টুঙ্গিপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রাখা, যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির মহাসমাবেশে বোমা হামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, ১৭ আগস্ট সারা দেশে একই সঙ্গে বোমা হামলায় জঙ্গিরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে। একই সঙ্গে গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই জঙ্গিগোষ্ঠী সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত থাকতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এদিকে সম্প্রতি জঙ্গি অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও জোরালো করতে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গঠনের বিষয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর পরপরই গঠন করা হয় কমিটি। সরকারের কাছে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেশ কয়েকটি এনজিও, বেসরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থ জোগাচ্ছে। জঙ্গিদের অর্থদাতার উৎস অনুসন্ধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মন্ত্রিকমিটি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও বৈঠক করেছে কয়েক দফা।
সূত্রমতে, জঙ্গি গোষ্ঠীকে অর্থদাতাদের একটি প্রাথমিক তালিকা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। বেসরকারি একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও প্রতিষ্ঠান ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। জঙ্গি বিস্তারে নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করতেও কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
সশস্ত্র জঙ্গির টাকা যেভাবে আসে : ড. আবুল বারকাত তার গবেষণায় বলেছেন, অনেকেই মনে করেন এ দেশে সশস্ত্র জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনে সমুদয় অর্থ বিদেশ থেকেই পেয়ে থাকে। সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি সংস্থাসমূহের অনুদানের বড় অংশ আসে বিদেশ থেকে। গবেষণায় বলা হয়, এ ধারণা বহুলাংশে সত্য নয়। এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বাহক শক্তিটি বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনে সত্তর-আশির দশকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক অর্থ পেয়েছে। এসব অর্থ-সম্পদ তারা সংশ্লিষ্ট আর্থ-রাজনৈতিক মডেল গঠনে বিনিয়োগ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিনিয়োজিত প্রতিষ্ঠান উচ্চ মুনাফা করছে। আর এ মুনাফার একাংশ তারা ব্যয় করছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে, একাংশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রসারে, আর একাংশ নতুন খাত-প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে।
মৌলবাদের অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হয় : যে কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট উত্তরণে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু হলেই বলা হয়েছে ‘ইসলাম বিপন্ন’। মিলিটারি শাসন ও স্বৈরাচার বলবৎ রাখতে ‘ইসলামের বিপন্নতা’ ছিল একমাত্র স্লোগান। একাত্তরে ‘ইসলামের বিপন্নতা’ বলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গুটিকয় বাঙালি মুসলমান নিয়ে শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস, রাজাকার ইত্যাদি বাহিনী গঠন করা হয়। এখনো রয়ে গেছে এর রেশ। মৌলবাদের কাছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাংক, বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ক্লিনিকের মতো জায়গায়।
আর এসব ব্যবসার লাভ থেকেই বিকশিত হচ্ছে মৌলবাদের অর্থনীতি।

সর্বশেষ খবর