বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
পাকিস্তানে স্কুল ট্র্যাজেডি : শোকে স্তম্ভিত বিশ্ব

কয়েক মিনিটেই মৃত্যুপুরী

বেঞ্চের নিচে লুকিয়েও রেহাই পায়নি নিষ্পাপ শিশুরা

কয়েক মিনিটেই মৃত্যুপুরী

সারি সারি লাশ। বেশির ভাগই নিষ্পাপ, ছোট্ট সোনামণির। তাদের এই মরদেহ কবরে রাখতে গিয়ে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। পাকিস্তানের পেশোয়ারের এই দৃশ্য কাঁদিয়েছে গোটা বিশ্বকে। গত পরশু পেশোয়ারের একটি বিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে প্রাণ হারায় ১৩২ জন স্কুল শিশু ও নয়জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। আহত হয় ১২৫ জন। পরে সেনাবাহিনীর অভিযানে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া ছয় জঙ্গিও নিহত হয়। হামলায় নিহতদের গত দুই দিনে দাফন শেষ হয়েছে। দাফনের সময় সন্তান হারানো বাবা, মা ও আত্মীয়-স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জঙ্গিরা স্কুলটিতে ঢুকেই নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। মাত্র কয়েক মিনিটেই স্কুলটি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। অনেক শিশু বেঞ্চের নিচে, দরজার আড়ালে লুকিয়েও রেহাই পায়নি। বর্বর তালেবান জঙ্গিরা তাদের টেনেহিঁচড়ে বের করে হত্যা করে। অধিকাংশ শিশুকেই হত্যা করা হয় মাথায় গুলি করে। জঙ্গি হামলায় ১৫ বছর বয়সী ছেলে হারানো এক বাবা বলেন, ‘যখন খবর পেলাম, আমি তখন আদালতে। খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটে গেছি। আমার মানিকের বুকের ডান দিকে আর হাতে গুলি লেগেছিল।’ তিনি কান্নায় ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। ১০ বছর বয়সী গুল শেরের চাচা সাজিদ খান জানান, তার ভাইপোর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। চোখ মুছতে মুছতেই তিনি বললেন, ‘আমরা এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পারব না। আমরা মহান আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।’ হৃদয়বিদারক ওই ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। গতকাল থেকে এই শোক শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় পাকিস্তানের চির বৈরী রাষ্ট্র ভারত ধিক্কার জানায়। গতকাল ভারতের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, বিদেশে পাকিস্তানি দূতাবাসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। খোলা হয়েছে শোকবই। 

বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড়, জঙ্গি দমনে পাশে থাকার ঘোষণা : বর্বরোচিত এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একাট্টা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাকিস্তানে প্রায়ই জঙ্গি হামলা হয়। তবে দেশটিতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা এটি। নিরপরাধ শিশুদের এই হত্যাকাণ্ডকে ‘কাপুরুষোচিত’ বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি মুন। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘চরম দুঃখজনক এ সময়ে সব ধরনের সহায়তার জন্য ভারত প্রস্তুত বলে পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হামলার ঘটনাকে ‘বর্বরোচিত’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের পাশে থাকারও ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপের নেতারাও হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
পেশোয়ার হামলার নিন্দা আফগান তালেবানের : তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) জঙ্গিদের চালানো আট ঘণ্টার ওই হামলা থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই বর্বরোচিত হামলাকে মেনে নিতে পারচ্ছে না আফগানিস্তানের জঙ্গি সংগঠন আফগান তালেবানরাও। তারা বলেছে, ‘আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাত (তালেবানের প্রাতিষ্ঠানিক নাম) সব সময় শিশু ও নিরপরাধ মানুষ হত্যার নিন্দা জানিয়ে আসছে।’ তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘সচেতনভাবে নিরপরাধ পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা ইসলামী নৈতিকতাবিরোধী। প্রত্যেক ইসলামী সরকার ও আন্দোলনকে মৌলিক এ নীতিটি মেনে চলতে হবে।’ 

পাকিস্তান তালেবানের (টিটিপি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত না হলেও আফগান ও পাকিস্তান উভয় তালেবানই মোল্লা ওমরকে তাদের নেতা মানে। 

ফাঁসি কার্যকরে নিষেধাজ্ঞা তুলল পাকিস্তান : গতকাল পেশোয়ারের গভর্নর হাউসে প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরিফের সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ওপর আগে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন। পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র মহিউদ্দিন বাওয়ানি জানান, পাকিস্তানের আইনে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও ২০০৮ সালে আসিফ আলী জারদারির সরকারের সময় ফাঁসি কার্যকরের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আসে। তার মেয়াদ গত বছর জুলাই মাসে শেষ হয়ে গেলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আহ্বানে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ সরকারও নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে। 

ভারতে শোক : পাকিস্তানের বিদ্যালয়ে ১৪১ জনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে গতকাল ভারতজুড়ে সব স্কুলে ২ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অন্যান্য সব সংসদ সদস্যও দুই মিনিট নীরবতা পালন করেছেন বলে জানিয়েছে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’। এর আগে মঙ্গলবার রাতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ফোনে শোকবার্তা জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লির মডার্ন স্কুলে পেশোয়ারে নিহত স্কুলশিশুদের স্মরণে একটি বিশেষ অ্যাসেম্বলি অনুষ্ঠিত হয়।
 এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা, টাইমস অব ইন্ডিয়া

সর্বশেষ খবর