শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
সুন্দরবনে ট্যাংকার ডুবি

বিপর্যয়ের নেপথ্যে মংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেল

বিপর্যয়ের নেপথ্যে মংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেল

সুন্দরবন বিপর্যয়ের নেপথ্যে বাংলাদেশ-ভারত নৌ-বাণিজ্য প্রটোকলভুক্ত বাগেরহাটের মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল। এটি চালু থাকলে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল ট্যাংকার দুর্ঘটনা ঘটত না। এ কারণেই সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন। ২০০৯ সালে এই চ্যানেলের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী অংশে নামমাত্র খননকাজ শুরু করেই দুই মাসের মাথায় তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ। পরে ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে চলাচল শুরু হয় সব ধরনের নৌযান।

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে সরেজমিন গেলে এলাকাবাসী, ব্যবসায়ী, নৌ-শ্রমিক ও জনপ্রতিনিধিরা এই নৌরুটের বিভিন্ন দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন। রামপাল থানাঘাটের নৌকাচালক সুলতান আহম্মেদ বলেন, 'একুশ বছর ধরে এই নৌরুটে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। নৌরুটটি বন্ধ হওয়ায় আমাদের পেটে ভাত নেই। আজ আমাদের অর্ধাহারে-অনাহারে কাটাতে হচ্ছে। এই চ্যানেলটি খননের জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।'

চ্যানেলের দক্ষিণ পাশের স্থানীয় পেড়িখালী এলাকার বাসিন্দা বাবুল শেখ ও মুক্ত হোসেন বলেন, এই নদী খনন না করা হলে বর্ষাকালে এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে আরও দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেবে। তবে নদী খননের আগে প্রভাবশালীদের আটকে রাখা সরকারি খাল খনন ও বাঁধ কাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে মংলা ও রামপাল উপজেলার আটটি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নৌরুটের বুকে আটকে থাকা 'ফরাজী পরিবহন' নামের কার্গর্োর চালক জাহাঙ্গীর বলেন, 'সুন্দরবনের নৌরুটটি বন্ধ হওয়ায় খুলনা থেকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় কার্গোটি নিয়ে এ রুট দিয়ে যাওয়ার সময় রামপালের কুমারখালী নদীর চরে সাত দিন ধরে আটকে আছে। কার্গোয় থাকা মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে চলাচলে অনেক পথ ঘুরতে এবং বনদস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হয়। এ রুটটি চালু থাকলে আমাদের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে চলাচল করতে হতো না।' চ্যানেলের কোলঘেঁষা স্থানীয় পেড়িখালী ইউপির সদস্য শাহাদাত হোসেন বলেন, এই চ্যানেলটি বন্ধ থাকায় বর্ষাকালে এলাকায় পানি উঠে ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। এই নদী খননের আগে ক্ষমতাধর দখলবাজদের চিংড়ি ঘেরের নামে আটকে রাখা সরকারি খাল অবমুক্ত করা জরুরি।' এলাকাবাসী জানান, রামপাল উপজেলার ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী মহল খনন করা প্রবহমান খালগুলো দখল করে দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছে। ফলে এ নদীর প্রবাহিত পানি ওই শাখা খালগুলোতে প্রবেশ করতে না পারায় নদী মরে গেছে। এই নদীর প্রবাহিত পানি ওই শাখা খালগুলোতে প্রবেশ করতে পারছে না বলেই দ্রুত নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্ভোগ।

রামপাল নদী-খাল রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন শেখ বলেন, সুন্দরবন ও মংলা বন্দর রক্ষায় আন্তর্জাতিক নৌরুট মংলা-ঘষিয়াখালী বাঁচাতে হলে মংলার সব সংযোগকারী রেকর্ডীয় খাল এবং এর ওপর অবৈধ বাঁধ ও স্থাপনা অপসারণ করে খননের বিকল্প নেই। এই চ্যানেল বন্ধের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের চিংড়ি ও মৎস্য ঘের চাষ। এ কারণে এলাকার হাজার হাজার মানুষকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে শনিবার সকালে রামপালে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর বুকে রামপাল উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি, রামপাল নদী খাল রক্ষা কমিটি, সিডিপি, পিআরভি, বাপাসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জনসাধারণকে নিয়ে মানববন্ধন করা হবে।

বাংলাদেশ-ভারত নৌ-বাণিজ্য প্রটোকলভুক্ত নৌপথের মৃতপ্রায় মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের প্রায় ২২ কিলোমিটার অংশে খননকাজ ধীরগতিতে চলছে।

এক সপ্তাহে খননের পর অবমুক্ত : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাবান চিংড়ি চাষিদের দখলে থাকা মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের দুই পাশের সব সরকারি খাল অবমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়ার পর গতকাল ঘটনাস্থলে ছুটে যান খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ ও বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু. শুকুর আলী। এক সপ্তাহের মধ্যে ক্ষমতাবান চিংড়ি চাষিদের দখলে থাকা সরকারি সব রেকর্ডীয় খালে খননকাজ শুরু ও খনন শেষে খালগুলো অবমুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার।

পরিবেশবাদীদের অভিমত : সুন্দরবনের নদী-খালে যে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল তা এখন দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিকর তেলের ধকল কাটিয়ে নদী-খালে কখন প্রাণের স্পন্দন দেখা যাবে তা বলা দুরূহ। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার আগে এসব নদীতে ঝাঁক বেঁধে রেণু পোনার দল ছুটে বেড়াতে দেখা যেত, যা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। প্রাণের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

জুনের মধ্যে খনন : মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খননকাজ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। বুধবার নৌ-মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। সভায় জানানো হয়, ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলটির এক কোটি ঘন মিটার মাটি খনন করতে হবে।

৬৫ হাজার লিটার তেল সংগ্রহ : গত সাত দিনে সুন্দরবনের শ্যালা নদী ও আশপাশের খাল থেকে সংগ্রহ করা ৬৫ হাজার ৮০০ লিটার ফার্নেস অয়েল ক্রয় করেছে পদ্মা অয়েল। শুক্রবার থেকে গতকাল পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দারা এ তেল সংগ্রহ করেন। দেড় শতাধিক নৌকা নিয়ে শ্যালা নদী এবং এর আশপাশের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল তারা সংগ্রহ করছেন।

সুন্দরবন বিভাগে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ : সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বাগেরহাটে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) স্থাপন করা হয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নিয়মিত সবকিছু তদারক করছে। অপরদিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন অধিদফতরের খুলনা অঞ্চলের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

মেডিকেল টিম : পেট্রল ও ডিজেলের তুলনায় ফার্নেস অয়েলের ঘনত্ব বেশি। এতে দূষণকারী পদার্থও বেশি থাকে। পানিতে তেলের দূষণ ছড়ালে তা মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকরা যাতে কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত না হন সে লক্ষ্যে সেখানে অতিরিক্ত মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমও সেখানে কাজ করছে।

সহায়তার আশ্বাস : তেল সংগ্রহের কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন মংলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে তেল সংগ্রহ করছে এমন প্রায় আড়াইশ শ্রমিকের নামের তালিকা করা হয়েছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর