শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

মহিলা বডিগার্ড নিয়ে দুদকে সেই মুসা বিন শমসের

মহিলা বডিগার্ড নিয়ে দুদকে সেই মুসা বিন শমসের

দুর্নীতি দমন কমিশনে গতকাল নারী বডিগার্ডসহ মুসা বিন শমসের (বামে) দুই সুন্দরী দেহরক্ষী - বাংলাদেশ প্রতিদিন

নারী বডিগার্ড নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) হাজির হলেন আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের। গতকাল সকাল ৯টায় সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে সাতটি গাড়ি নিয়ে আসেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন প্রায় অর্ধশত নিরাপত্তারক্ষী। কালো ব্লেজার আর নানা রঙের শার্ট পরে আসা নারী ও পুরুষ বডিগার্ডদের সবার চোখেই ছিল কালো সানগ্লাস। জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক আর চালচলনে নিজেকে প্রকাশ শোডাউন বলে মনে করেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। মুসা বিন শমসের কালো রঙের ব্লেজার, সবুজ শার্ট ও লাল টাই পরে আসেন। হাতে ছিল সোনালি রঙের ঘড়ি ও হীরক খচিত ব্রেসলেট। সাদা রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জে (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৫০০৮১) চড়ে রাজকীয় কায়দায় দুদকে প্রবেশ করেন আলোচিত এই ব্যবসায়ী।

বাণিজ্য সাময়িকী বিজনেস এশিয়ার সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে গত ৩ নভেম্বর কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে মুসা বিন শমসেরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। সুইস ব্যাংকে এই ব্যবসায়ীর সাত বিলিয়ন ডলার রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক কার্যালয়ে মুসাকে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। আলোচিত এই ব্যবসায়ীকে তলব করে ৪ ডিসেম্বর গুলশানের বাসা ও বনানীর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে চিঠি পাঠায় দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে অর্থ পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করলেও সুইস ব্যাংকে টাকা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্যের বেয়াই মুসা বিন শমসের। মুসার বড় ছেলে ববি হাজ্জাজ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন। ১৯৫০ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশের ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কড়িয়াল গ্রামে জন্ম নেওয়া মুসা ড্যাটকো গ্রুপের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করলেও '৭১-এ তিনি রাজাকার ছিলেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। স্বঘোষিত ধনকুবের মুসা বিন শমসের আশির দশকের শুরুতে 'আদম ব্যবসায়ী' (জনশক্তি রপ্তানিকারক) ছিলেন। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের এই আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী। তবে তার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে আনে। কিন্তু বিদেশে তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই বলে জানা গেছে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, পেশায় অস্ত্র ব্যবসায়ী বলা হলেও তিনি কোন দেশে অস্ত্র ব্যবসা করেন তার কোনো কাগজপত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি জীবনেও করেছেন কিনা তাও জানা যায়নি। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তার দৃশ্যমান শিল্প-কলকারখানা কিংবা কোনো ধরনের বাণিজ্য নেই। এক সময়ে 'আদম ব্যবসা' করে গৃহীত অর্থ বিদেশে ব্যাংকে রেখে যে সুদ পান তা দিয়েই তার চমক।

২০১০ সালে তিনি পশ্চিমা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। সাত বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকে যাওয়ার খবরে তিনি আবারও আলোচনায় আসেন। এ অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বলা হয়েছে, মুসা বিন শমসেরের 'লেনদেন অনিয়মিত'। টাকা তুলতে না পারার কারণ এক কোটি ডলার দামের একটি 'মন্ট বাঙ্ক কলম'। ফ্রান্সে তৈরি ওই কলম মাত্র একটিই তৈরি করে নির্মাতা কোম্পানি। ২৪ ক্যারেট সোনায় তৈরি কলমটিতে রয়েছে সাত হাজার ৫০০টি হীরকখণ্ড। এক কোটি ডলারের বেশি লেনদেনের কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি হলেই নাকি মুসা বিন শমসের ওই কলম দিয়ে স্বাক্ষর করেন। মুসা বিন শমসের বিশ্বাস করেন, এ কলম দিয়ে যে ব্যবসায় স্বাক্ষর করবেন তা সফল হবেই। সারা বছরই কড়া প্রহরায় এ কলমটি রক্ষিত থাকে সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে। প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ওই কলম নিয়ে যাওয়া হয় নির্দ্দিষ্ট স্থানে। আবার সেভাবে ফেরত নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই কলমটি তুলতেই বাধা দিয়েছে তাকে। আর এ কারণে টাকাও তুলতে পারেননি তিনি। কলম তুলতে যাওয়ার পরই তিনি জানতে পারেন সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত তার সব সম্পদই জব্দ করা হয়েছে। একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিলে একবার তার সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু পরে সেই প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। গতকাল দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের পর আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের জানান, 'আমার বিষয়ে যা বলা হয়, আমি সাত বিলিয়ন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছি। কেউ কোনো দিন এত টাকা এদেশে আয় করতে পারেনি, পারবেও না। আমি এই টাকা বিদেশে উপার্জন করেছি। দুদক আমাকে ডেকেছে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক বিধায় আমি এসেছি।' অভিযোগের তদন্ত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সব গল্পেরই একটি ইতিহাস থাকে, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সত্য বেরিয়ে আসে।' তিনি বলেন, 'সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা ওই টাকা উদ্ধার করা গেলে পদ্মা সেতু, দুস্থ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষকসহ সামাজিক গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখব। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। পদ্মা সেতু শুধু আমার নয়, আমার বাবারও স্বপ্ন ছিল। পদ্মা সেতু গোয়ালন্দ থেকে আরিচা, নগরবাড়ী- এখানে অ্যাঙ্গেল একটা ব্রিজ হবে।' দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'মুসা বিন শমসেরের সব কিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি অবৈধ কোনো ব্যবসায় সম্পৃক্ত কিনা তদন্ত চলছে। পাশাপাশি নিজের অর্থ সম্পদের কাল্পনিক প্রচারণা চালিয়ে তিনি বাংলাদেশে অন্য কোনো ফায়দা লুটতে চান কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হবে।'

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর