রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রতিবেদন

রাজনৈতিক সহিংসতায় ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ

* ২০১৩ সালে সহিংসতায় এগিয়ে বিএনপি-জামায়াত * দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছরে ২৭ ভাগ ঘটনায় দায়ী ছাত্রলীগ

রাজনৈতিক সহিংসতায় ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ

রাজনৈতিক সহিংসতায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম। প্রথম অবস্থানে রয়েছে সিরিয়া, আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ইরাক, দক্ষিণ সুদান। ভারতের অবস্থান ১৮তম। সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড। গতকাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘শাসন পরিস্থিতি, বাংলাদেশ ২০১৩ : গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে এ পরিস্থিতির জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে দুই হাজার ৭২৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বছর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। এতে নিহত হয়েছেন ৫১৯ জন। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ, অর্থাৎ এক হাজার ১৮০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে শুধু ২০১৩ সালে। ২০১৩ সালে এক বছরেই নিহত হয়েছেন ২৭৩ জন, যা আগের চার বছরের চেয়ে বেশি। আহত হয়েছেন ৩৩ হাজার ৭০২ জন। ভাঙচুর করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৯টি যানবাহন, দোকান, বাড়ি ও ঘর। আগুনে পুড়েছে ৫১৪টি যানবাহন ও দোকান। এই সহিংসতার জন্য দায়ী করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতকে। সহিংসতায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট।   

তবে একক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এগিয়ে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ শাসক দলের বিরুদ্ধে। দেড় হাজার সহিংসতার ৮৯৪টিতে জড়িত শাসক দল। গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কারণেই ২৭ ভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আগের চার বছরে বিএনপি এককভাবে মোট সহিংসতার ২৫ শতাংশে জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জামায়াত জড়িত ৮ শতাংশে। ২ শতাংশ সহিংসতা বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধভাবে করেছে। ৫ শতাংশের ঘটনায় জড়িত ছাত্রদল। ছাত্রশিবির জড়িত ৪ শতাংশ ঘটনায়। বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পরিমাণ ৬০ শতাংশ। ব্র্যাক সেন্টার ইন মিলনায়তনে প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। বিআইজিডির’র নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতান হাফিজ রহমানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, বিআইডিসি’র গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়েক সেন প্রমুখ। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইডিজির গবেষণা প্রধান মিনহাজ মাহমুদ। এ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি সংস্থা, দাতাগোষ্ঠীসহ দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।  

প্রতিবেদনটিতে শুধু সহিংসতা নয়, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, সংসদে ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলাদের আধিপত্য, পারিবারিক রাজনীতি চর্চা, বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয়করণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল থাকলেও পিছিয়ে পড়েছে রাজনীতি। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডই দায়ী। সহিংসতার জেলাওয়ারি চিত্রে সবার ওপরে ঢাকার নাম। সবার নিচে রয়েছে বান্দরবান। প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংসদে মোট এমপির প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী। অষ্টম ও নবম সংসদে এ সংখ্যা ছিল ৫৯ ও ৬০। এবারের সংসদে বিএনপি না থাকলেও মোট এমপির ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। আগের সংসদে বিএনপির ৭৭ শতাংশ এমপি ছিলেন ব্যবসায়ী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র আছে বলেই অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সংসদ মানেই গণতন্ত্র না। গণতন্ত্রে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য সংলাপ প্রয়োজন। তবে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান মেনেই সংলাপ করতে হবে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভিতর গণতন্ত্রের পাশাপাশি দেশে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারও থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের জন্য স্পেস দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সে স্পেস আজকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গঠনমূলকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে গঠনমূলক হবে না। ড. বিনায়ক সেন বলেন, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি রাজনৈতিক উন্নয়নকে ছাপিয়ে যায় তাহলে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ভর করে বেঁচে আছে। তিনি বলেন, অদক্ষ শ্রমিকরা যখন অর্থনীতির ধারক হন তখন তারা গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় হতে পারে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সুবিধাভোগী বলেই জাতীয় বিভিন্ন সংকটে তারা নিশ্চুপ থাকে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতন্ত্র। সংলাপের মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিনায়ক সেন আওয়ামী লীগকে সংলাপে আসার, বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগ করার এবং জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের ত্যাগ করার আহ্বান জানান। অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের রাজনীতির ভাষা অনেক বদলে গেছে। রাজনীতিবিদরা এখন জনগণের ভাষায় কথা বলেন না। এখন সুশাসনের অভাব (মিসগভর্নেন্স) লাভজনক হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুশাসনের অভাবই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ খবর